রাঙামাটি কী বার্তা দিল?

১৩ জুন মঙ্গলবার রাঙামাটিসহ বিভিন্ন পার্বত্য এলাকায় ভয়াবহ ভূমিধসে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও মানবিক বিপর্যয়ের পর লংগদুর ঘটনাটি মনে পড়ল। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় যুবলীগের এক কর্মী হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদে জড়িয়েছিল পাহাড়ি ও বাঙালিরা। ‘বিবাদ’ বলাটা বোধ হয় যথার্থ হলো না, কারণ একতরফা আক্রমণের শিকার লংগদুর পাহাড়িরা কোনো প্রতিরোধ তো গড়ে তোলেইনি; বরং বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল দূরের কোনো পাহাড়ে বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের দুই শতাধিক বাড়িঘর। তাদের অনেকেই এখনো বসতভিটায় ফিরে আসতে পারেনি ।
ঘটনাটি মনে পড়ার কারণ, বিভেদ-কোন্দলে জর্জরিত মানুষ আজ যখন প্রকৃতির নির্মম আঘাতের মুখোমুখি হলো, তখন তারা উপলব্ধি করতে পারছে পাহাড়ি-বাঙালি, জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিভাজন নয়, বড় বিপর্যয়ে মানুষের পাশে দঁাড়াতে হয় মানুষেরই পরিচয়ে। মাটির নিচে চাপা পড়া বাঙালিকে যেমন উদ্ধার করছেন পাহাড়ি প্রতিবেশী, তেমনি পাহাড়ির লাশ উদ্ধার করতে শোকে বিহ্বল স্বজনকে সাহায্য করছেন বাঙালিরা। প্রতিকূল প্রকৃতি এভাবেই মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক কাতারে। স্বাভাবিক সময়ে কী করে যে আমরা এই সহমর্মিতার কথা ভুলে যাই! কেন মনে রাখতে পারি না, মোটরসাইকেল হাতিয়ে নেওয়ার জন্য যে কজন দুর্বৃত্ত বাঙালি যুবককে হত্যা করেছিল, তাদের পরিচয় ‘পাহাড়ি’ বা ‘বাঙালি’ নয়, তারা শুধুই দুর্বৃত্ত। তাদের শাস্তি আমরা সবাই চাই, কিন্তু তার অপরাধের দায় কেন চাপিয়ে দেব সব পাহাড়ির কঁাধে? কেন আমরা কিছু চক্রান্তকারীর উসকানিতে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হব?
যা-ই হোক, সাম্প্রতিক ভূমিধসের প্রসঙ্গে আসি। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ধসের কারণে আমাদের পর্যটনের বিজ্ঞাপন, মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটির বিরাট অংশ আজ শুধুই এক ধ্বংসস্তূপ। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ নানাভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা চলছে। মোটা দাগে যে কারণগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারি তার মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, উন্নয়নের নামে নিয়মিত পাহাড় কাটা, পাহাড়গুলো সরকারি-বেসরকারি নানাভাবে লিজ দেওয়া এবং কাঠ ব্যবসায়ীদের নির্বিচারে গাছ কাটা। এই সব ধরনের তৎপরতার সঙ্গেই রয়েছে প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তির সম্পৃক্ততা।
ভূমি গঠনের দিক থেকে আমাদের পাহাড়গুলো বালু ও মাটির পাহাড়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের দার্জিলিং বা নৈনিতালের মতো পাথর বা শিলার নয়। তবু ৩০ বছর আগে যখন সমতলের মানুষ পাহাড়ে বসতি গড়তে শুরু করেনি, তখন পাহাড়ধসের ঘটনা শোনা যায়নি। পাহাড়িরা যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাস করে আসছে। তারা ঐতিহ্যগতভাবে সেখানকার প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বসবাস করতে অভ্যস্ত। এমনকি তারা মার্চ-এপ্রিলে পাহাড়ে আগুন দিয়ে যে জুম চাষ করে, সে ক্ষেত্রেও দেখা যায় তারা তখন শুধু ঝোপঝাড় পোড়ায়, গাছ বা বনভূমি পোড়ায় না।
বান্দরবানের থানচি, রুমা বা রোয়াংছড়িতে পাহাড় থাকলেও সেখানে কিন্তু সহসা পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে না এবং প্রাণহানির কথাও শোনা যায় না। কারণ, সেখানে খুব বেশি একটা নতুন বসতি হয়নি। অন্যদিকে রাঙামাটি ও অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় সমতলের মানুষ নিজেদের জীবনাচরণের সঙ্গে মিলিয়ে পাহাড়ি ভূমি কেটে সমতলের জমিতে রূপান্তর করে বসবাস করতে শুরু করে। এতে পাহাড়ের ভৌগোলিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইদানীং পাহাড়িরাও অনেকেই সমতলের মানুষের মতো পাহাড় কেটে বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাহমান নাসিরউদ্দিন বলেন, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর ত্রিপুরা থেকে প্রত্যাগত অনেক শরণার্থী রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে বসবাস করতে শুরু করে। এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির পর এই প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে পাঁচটি ভূমি কমিশন হলেও পুনর্বাসনের কাজটি হয়নি। অন্তত ২০ হাজার আবেদন জমা আছে, একটিও মীমাংসা হয়নি। বাঙালিদের পাশাপাশি এই প্রত্যাগত শরণার্থীদের একটি বড় অংশ পাহাড়ের পাদদেশে বাস করে। রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অন্যান্য উন্নয়নকাজে নিয়মিত পাহাড় কাটা হচ্ছে। কিন্তু তাতে প্রতিরোধক দেয়ালসহ প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা পার্বত্য জেলাগুলোতে ভূমিধসের কারণে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়।
নির্বিচারে গাছ কাটা পাহাড়ে ভূমিধস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত একটি চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে কাঠ ব্যবসায়ীরা এখানে বন উজাড়ের মহোৎসব চালিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হলে লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ ও তৎপরতা দেখা যায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, তারপর যেই কি সেই। কথাটা বলা হলো মোটা দাগে। পাহাড়ে সংবাদ সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত লোকজন জানেন, কীভাবে জোত পারমিটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাচার হচ্ছে গাছ। এমন চলতে থাকলে আর ১০ বছরের মধ্যে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানকার ভঙ্গুর পাহাড়ের মাটি ধরে রাখার জন্য আর কোনো রক্ষাকবচই থাকবে না। রাঙামাটিতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ তৈরির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কারও অজানা নয়। লাখো পাহাড়ির নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের কারণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশির ভাগ ইউনিটই সারা বছর বন্ধ থাকে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। হ্রদের কারণে বদলে গেছে রাঙামাটিসহ বিশাল পার্বত্য এলাকার ভূমিরূপ। বিশাল পাহাড়সারি এখন হ্রদের নিচে কাদার দলা হয়ে পড়ে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো বর্তমানের অতি জনসংখ্যার ভার। যে যেভাবে পারছে, পাহাড় শুষে খাচ্ছে। এই শোষণের ভারেই কি এমন ধস?
পাহাড়গুলো লিজ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। আমবাগান, কলাবাগান, রাবারবাগান বা মাছ-মুরগির খামার ইত্যাদি করার জন্য ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মেয়াদে এসব পাহাড় ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে নিয়মিত নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। সাধারণত বিত্তবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব পাহাড় ইজারা পেয়ে থাকেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইজারাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা চুক্তির সীমা লঙ্ঘন করে বাড়িঘরসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য
নষ্ট হচ্ছে।
শুরুতে লংগদুর ঘটনা উল্লেখ করে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্কের কথা বলেছি। আসলে ১৯৭৯ সালে প্রায় চার লাখ বাঙালিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এনে এখানে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিল জিয়াউর রহমানের সরকার। কয়েকটি গুচ্ছগ্রামে তাদের আশ্রয় দিয়ে সরকারি রেশনের ব্যবস্থা করা হলেও তাদের আয়-উপার্জনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি তখন। ফলে এই হতদরিদ্র মানুষগুলো একদিকে আয়-উপার্জনের জন্য পাহাড়ি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করেছে, অন্যদিকে এখানকার আদি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয়েছে। পুনর্বাসিত বাঙালিদের অনেকের সন্তানাদির বয়সও এখন ২৫ ছাড়িয়েছে। জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা তাদের গভীর হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন একদিকে পাহাড়, বনভূমি রক্ষা এবং পাহাড়িদের জীবনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করা যেমন দরকার, তেমনি পুনর্বাসিত বাঙালিদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা সরকারের দায়িত্ব। পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে, কিন্তু শান্তি আসেনি পাহাড়ি বা পুনর্বাসিত বাঙালি কারও জীবনে। পাহাড়ধসে প্রাণ ও সম্পদহানির এই বিরাট ট্র্যাজেডির পর আমাদের নীতিনির্ধারকেরা যদি এ বিষয়ে সচেতন না হন, ভবিষ্যতে আরও বড় প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]