শুভ্র সমুজ্জ্বল গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ

গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ
গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ

প্রিয় গাজী ভাই, আপনি চলে গেলেন আপনাদের গাজী ভবন ছেড়ে। বীথি ভাবি, শারমিন বাবু, শুভ্র, নাতি-নাতনি, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, পরিচিতজনদের ছেড়ে। স্মৃতি ভারাক্রান্ত স্বজনেরা। আপনার কথা বলছি, ভাবছি, লিখছি; কিন্তু আপনি নেই ইহজগতে। আপনি কখনো আত্মপ্রশংসায় উৎফুল্ল হতেন না। আদৌ কি আমরা আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলাম? আপনার কৃতিত্ব সচিত্র সন্ধানীর সৌরভ আপনাকে গুণমুগ্ধদের কাছে টেনে নিয়েছে। আপনি সলাজে নিজের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
রাষ্ট্রীয় সম্মান, নানা সম্মাননা, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ নানা গুণীজন সংবর্ধনা যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আপনার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে সংস্কৃতির বন্ধনে সম্পৃক্ত। তাঁদের অনেকেরই চলার পথকে মসৃণ করেছেন, তাঁদের স্বপ্ন দেখার চেতনাকে উদ্দীপ্ত করেছেন আপনি। আপনিও আলোকিত পথে চলেছেন তাঁদের সঙ্গী করে। জীবনসায়াহ্নে আপনার কাছে পরোক্ষ অনুরোধ এসেছিল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা জাতীয় সম্মাননার জন্য আপনার জীবনতথ্য-পরিচিতি যেন আপনি বা আপনার পক্ষে কেউ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পৌঁছে দেন।
হয়তো সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই রীতি-ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু আপনি এই কাঙালিপনা নাকচ করেছেন, জীবনতথ্য সরকারি দপ্তরে জমা দিয়ে সম্মাননা পাওয়ার বিধিবিধানকে অবজ্ঞা করেছেন। আপনার পক্ষে পরিবারের সন্তান-স্বজনেরা কেউ যেন সেই প্রক্রিয়ার পথে না যায়, সেই কথা বলে গেছেন আত্মজ শুভ্রকে। এখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্টজনেরা নিজ প্রয়াসে যদি পদক্ষেপ নেন, তবেই হয়তো কিছুটা স্খালন হবে আমাদের রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানের চিরাচরিত প্রথার অপমানিত পদক্ষেপ। আপনার সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে কালের কণ্ঠে ১২ জানুয়ারি, বললেন সে কথা। পড়েছি। স্মৃতিসম্মাননা নিয়ে, স্মৃতিকথার মধ্যে ‘মালেকা বেগম’-এর কথা বলেছেন। আমি কৃতার্থ, গাজী ভাই।
এসবই পরোক্ষ বচনে আপনাকে আপনার সঠিক পরিচয়ে স্মরণ করার প্রয়াস। প্রত্যক্ষ কথায় ফিরে আসি। ২৯ মে (২০১৭) সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে আপনার বাড়ির উদ্দেশে পাড়ি জমিয়ে বিকেল চারটায় পৌঁছাই গাজী ভবনে। আপনাদের মেয়ে শারমিন বাবুকে ফোনে জানাই। সে তখন ‘এবিসি রেডিও’ ভবনে পেশাগত কাজে ব্যস্ত ছিল। জানাল, গাজী ভবনে ওর গাড়ি রাখার গ্যারেজে আমার গাড়িটা রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। লিফটের ১০-এ চাপ দিয়ে ভাবছিলাম বিকেলে হয়তো আপনারা বিশ্রাম নিচ্ছেন, ঠিক হলো কি এই অবেলায় আসা? আপনার ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা ছিল। আপনি বসার ঘরে বসে ছিলেন। উঠে এসে পরম মমতায় হাত ধরে নিয়ে গেলেন ঘরের ভেতরে।
সেদিন আপনি ও আমি প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেছিলাম পুরোনো স্মৃতিতাড়িত হয়ে। আপনার সঙ্গে পরিচয়, শ্রদ্ধাপূর্ণ ঘনিষ্ঠতায় কাটানো প্রায় ৪০ বছরের মধ্যে সেই দিনই প্রথম আপনার হাত জড়িয়ে বসে ছিলাম এক ঘণ্টা ধরে। আপনিও পরম স্নেহে সেই বন্ধনে ধরা দিয়েছিলেন। চোখে পানি টলটল করছিল আমার, লুকানোর জন্য ছল করেছি চোখে কী যেন পড়েছে বলে।
আপনি সেই এক ঘণ্টাজুড়ে একাই বলে গেলেন পরম শ্রদ্ধেয় খালাম্মা জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি বইটির প্রথম প্রকাশনা থেকে ৪০তম সংস্করণের প্রকাশনার সময়কালের স্বর্ণযুগের কথা। বলেছিলেন শিগগিরই ৫০তম প্রকাশনা হয়ে যাবে। প্রতিটি প্রকাশনা পাঠক-প্রীতিধন্য হয়ে দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। ধুমধাম করে নতুন সংস্করণের প্রস্তুতি চালিয়েছেন আপনি।
স্মৃতিতাড়িত হয়ে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন যে প্রথম আলো অফিসে গিয়েছিলেন কয়েক দিন আগে, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর শিষ্য-শিল্পী তরুণ অশোক কর্মকারকে বলেছেন অবিকল কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা প্রচ্ছদচিত্রের অনুকরণে একাত্তরের দিনগুলি বইটির নতুন সংস্করণের প্রচ্ছদ দ্রুত এঁকে দিতে। সব প্রস্তুতি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আপনি যে অগস্ত্যযাত্রায় পাড়ি দেবেন, সেটা তো সেদিন বলেননি! বরং বলেছিলেন, দুরারোগ্য ক্যানসার প্রতিরোধ করে নতুন জীবনের সময়কালটা আরও যেন কয়েকটা বছর সুস্থভাবে কাটাতে পারেন, সেই প্রার্থনাই করছেন। না, কোনো ইহলৌকিক সুখ, ‘স্ত্রী-সন্তান-নাতি-নাতনি-ভাইবোন’দের সান্নিধ্যের জন্য নয়—শুধু একাত্তরের দিনগুলি বইটির ৫০তম সংস্করণের প্রকাশনা করে যাওয়ার তীব্রতম আকাঙ্ক্ষায় বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছিলেন সেদিন।
বারবার ‘পঞ্চাশ’ শব্দটি নাকি মৃত্যুর সময়কালে বলেছিলেন ছেলে শুভ্রকে। এই শেষ আকাঙ্ক্ষাটি পূরণ করার দায়িত্ব আপনি অর্পণ করে গেলেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে।
অনেক স্মৃতিতাড়িত হয়ে লিখছি, জানি স্মৃতি রোমন্থনের লেখা এটা নয়। আপনাকে শ্রদ্ধা-স্মরণের জন্যই উৎসর্গিত করছি এই লেখা। তবু ‘আমিত্ব’ গ্রাস করছে। আপনাকে ও বীথি ভাবিকে অন্তরঙ্গ আলোকে জেনেছি ১৯৭৯-১৯৮৬ সময়কালে সচিত্র সন্ধানীতে পেশাগত কাজের সময়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম, পেশাগত কাজের প্রয়োজনে খণ্ডকালীন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকতাম। সচিত্র সন্ধানীতে চাকরি পাওয়ার অনুরোধ জানাতে পুরানা পল্টনের ‘কথাকলি’ অফিসে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আপনি আমাকে চাকরি যাচনার কোনো কথাই বলতে দেননি। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ভাই এবং আপনি এমনভাবে অনুরোধ জানালেন যেন আমি চাকরিপ্রার্থী নই, আপনাদের প্রস্তাবে আমি সম্মত হলে আপনারাই কৃতার্থ হয়ে যাবেন।
হতভম্ব আমি, জীবনসংগ্রামে, আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যাপৃত আমি ও মতিউর রহমান সেই সত্তরের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০-র দশকে আপনার আশ্রয়ে কাটিয়েছি পরম নিশ্চিন্তে। স্মরণ করছি, শ্রদ্ধা জানাচ্ছি কাইয়ুম ভাই, বেলাল ভাই, শফিক রেহমান ভাই, সৈয়দ শামসুল হক ভাইকে।
২৯ মে বিকেলে আপনাকে এবং বীথি ভাবিকে বলেছিলাম, শুভ্র সমুজ্জ্বল ২য় খণ্ড প্রকাশের ইচ্ছা আছে। সে জন্য আপনাদের সঙ্গে একান্ত আলাপনের সময় যাচনা করেছিলাম। আপনি আধো সংকোচে, বিনয় জানিয়ে বলেছিলেন, হবে হবে, একদিন আসবেন, কথা হবে। তবে আমি ঘুম থেকে উঠি দুপুর একটায়। বীথি ভাবি মৃদু ঝঙ্কারে, বিলোল কটাক্ষ হেনে বলেছিলেন, কেন, এক দিন সকালে ঘুম থেকে জাগলে কী হয়? হাসিতে উচ্ছল ৭৮ বছরের আপনি হয়ে গেলেন তরুণ প্রেমিক। জীবনসঙ্গিনীর মনের কথা বুঝে নিলেন। বললেন, ঠিক আছে, কবে আসবেন? বলেছিলাম, ১০ জুন বেলা ১১টায়। বলেছিলেন, পাক্কা কথা দিলাম।
না, গাজী ভাই, আপনি কথা রাখলেন না। ৯ জুন বেলা ৩টায় পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে। কিন্তু আমরা-আমি আপনাকে ছাড়ছি না। আমার প্রকাশিতব্য শুভ্র সমুজ্জ্বল বইয়ের জন্য জীবনসঙ্গিনীর আয়নায় গাজী শাহাবুদ্দিন-এর কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য বীথি ভাবির কাছে সময় চেয়েছি। আপনি আছেন, থাকবেন বাংলার সংস্কৃতি-ভুবনের সর্বত্র।
মালেকা বেগম: অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।