বিপর্যয়ের দিনগুলোতে মানুষের মুখ

১২ জুন ছিল তুষ্টি চাকমার চতুর্থ জন্মদিন। তার জন্মদিনটা এবার একটু ঘটা করেই পালন করেছিলেন মা রেখা ও বাবা প্রদীপ চাকমা। আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। কেউ কেউ মুঠোফোনে আনন্দের মুহূর্তগুলোর ছবি তুলে রেখেছেন, ‘বার্থডে গার্ল’ তুষ্টিরও ছবি তুলেছেন। সেই ছবিতে হাসিমুখে মিষ্টি মেয়েটাকে দেখা যাবে, কিন্তু তুষ্টিকে আর পাওয়া যাবে না। জন্মদিনের পরদিনই ১৩ জুন ভূমিধসে রাঙাপানি এলাকায় তুষ্টিদের বাড়িটি পাহাড়চাপা পড়েছে। তার মা-বাবাকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তুষ্টির লাশ। এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। সেখানে গিয়ে এই শোকস্তব্ধ দম্পতির হাতে কিছু ত্রাণসামগ্রী তুলে দিয়েছি আমরা, কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাইনি।

ঈদের সময় মাকে একটা শাড়ি কিনে দেবে বলেছিল আবদুর রহিম, মায়ের আদরের মুন্না (১৬)। রাঙামাটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (সিটিসি) ছাত্রটি টিউশনি করে কিছু টাকা উপার্জন করত। মাকে একটি শাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে রেখেছিল। কিন্তু শাড়ি আর কিনে দেওয়া হয়নি। ভয়াবহ দুর্যোগের দিনটিতে ভেদভেদী পোস্ট অফিস কলোনিতে ফজল আলী (৬০) আর দেলোয়ারা বেগমের (৪৪) দুই কামরার ঘরের একটি ধসে পড়লে সেই কামরায় থাকা মুন্নাও তলিয়ে গেছে খাদের অতলে। রাঙামাটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া দেলোয়ারা বেগমের হাতে প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা একটি শাড়ি তুলে দিলে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি, ‘আমার মুন্না কইছিল ঈদের সময়...।’

রাঙামাটির আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করে এ রকম কত ঘটনার যে সাক্ষী হতে হয়েছে!

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর মানুষের দুই রকম চেহারাও দেখা গেল। এখানকার পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে সম্প্রীতির অভাব আর বিভাজনের ভেদরেখা আছে, এ কথা তো বহুশ্রুত। কিন্তু বিরূপ প্রকৃতি যেন এখন এক করে দিয়েছে সবাইকে। ভেদাভেদ ভুলে একের দুঃখ-কষ্টে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অন্যজন। যেমন ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) থাকতেন বাঙালি অধ্যুষিত একটি পাড়ায়। রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে তাঁর বাড়িটিতে পাহাড় ধসে পড়লে চাপা পড়েছিলেন তিনি, তাঁর স্ত্রী, মেয়ে ও দুই ভাগনি। এ সময় তাঁদের চিৎকার শুনে আশপাশের বাড়ি থেকে বাঙালিরা বেরিয়ে এসে টিনের বেড়া কেটে উদ্ধার করেছেন তাঁদের। উদ্ধার করেই দায়িত্ব শেষ করেননি, অটোরিকশাচালক বেলালউদ্দিন আশ্রয় দিয়েছেন বাড়িতে, বেলালের মা পেয়ারা বেগম কাপড়চোপড় দিয়ে সাহায্য করেছেন ওই পরিবারের মেয়েদের। এ রকম ঘটনা একটি দুটি নয়, অনেক। দুর্গত ব্যক্তিদের সাহায্য করতে গিয়ে কেউ ভাবেননি  তাঁরা পাহাড়ি না বাঙালি। এভাবেই উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন চার সেনাসদস্য।

পাহাড়ধসে মা–বাবা হারিয়েছে এমন কয়েকটি শিশুকে নিয়ে ‘এই শিশুরা কার কাছে যাবে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম কয়েক দিন আগে। আশার কথা, লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি যোগাযোগ করে এই শিশুদের আশ্রয় দিয়ে তাদের ভরণপোষণ, লেখাপড়াসহ যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। শিশুকল্যাণে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘এসওএস শিশুপল্লি’ও এই শিশুদের দায়িত্ব নিতে চেয়েছে। অর্থাৎ মানবিক বিপর্যয়ের এই সময়টাতে মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে।

এর বিপরীত চিত্রটি হচ্ছে, ১৩ জুনের পাহাড়ধসের ঘটনার পর চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে জ্বালানি তেল, চাল-ডালসহ খাদ্যদ্রব্যের সংকটের ব্যাপারটি টের পেয়ে হঠাৎ করে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। অন্তত প্রথম দুই দিন এ নিয়ে চরম কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে স্থানীয় অধিবাসীদের। বিদ্যুৎ ছিল না এই দুই দিন। খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি কেরোসিন, মোমবাতির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার শত শত মানুষ এই লোভী ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে দিশেহারা হয়েছিল।

পরে কাপ্তাই হয়ে নৌপথে মালামাল আসতে শুরু করলে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসে। এ সময় স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। অটোরিকশাচালক সমিতির পক্ষ থেকে রাস্তায় মাইকিং করে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় না করতে চালকদের প্রতি অনুরোধ করতে দেখা গেছে। মানুষের বিপদ ও দুঃসময়কে পুঁজি করে ফায়দা লুটেছেন যেসব ব্যবসায়ী, ছোট শহরটিতে তাঁদের চিহ্নিত করা কঠিন কিছু নয়। এই ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ হবে বলে মনে করি আমরা।

পাহাড়ধসের পর প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের অনেক ক্ষোভ ও অভিযোগ শোনা গেছে। এ কথা সত্যি, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আবেগতাড়িত থাকেন, নিজেদের দুর্ভোগের জন্য কাউকে তাৎক্ষণিক দোষারোপ করার ক্ষেত্রে খুব একটা বাছবিচার করেন না। এসব কথা মাথায় রেখেও বলতে হবে, ঘটনার পাঁচ দিন পরও যে ক্ষয়ক্ষতির একটা পূর্ণাঙ্গ হিসাব প্রশাসন দিতে পারল না, এই ব্যর্থতা মেনে নেওয়া যায় না। ক্ষয়ক্ষতির হিসাবই যদি সময়মতো নিরূপণ করা না যায়, তাহলে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা যে সুষ্ঠু হবে না, তা তো বলাই বাহুল্য। এই ব্যর্থতার মূল কারণ সমন্বয়হীনতা।

রাঙামাটি সদর উপজেলার সাংসদ ঊষাতন তালুকদার পদাধিকার বলে জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির উপদেষ্টা। কিন্তু ঘটনার অব্যবহিত পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে তাঁকে ডাকা হয়নি। পাঁচ দিন পর তাঁকে ডাকা হয় বৈঠকে। একই আচরণ করা হয়েছে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান অরুণ কান্তি চাকমার সঙ্গেও। তিনিও সময়মতো ডাক পাননি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে। অনেকের ধারণা, এই দুজন জনপ্রতিনিধি জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা বলেই ক্ষমতাসীনদের উপেক্ষার শিকার। এ ছাড়া ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণের জন্য শুরু থেকেই এখানকার হেডম্যান-কার্বারিদের সম্পৃক্ত করা উচিত ছিল। তৃণমূলে কাজ করেন বলেই তুলনামূলক নির্ভুল হিসাবটি পাওয়ার জন্য তাঁরা ছিলেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ও এ কথাটিই বলেছিলেন।

জাতীয় দুর্যোগের সময় দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়, রাঙামাটির এই দুর্ঘটনা নতুন করে এই বার্তাটি আমাদের দিয়েছে। আমাদের নীতিনির্ধারক মহল এই বার্তা অনুধাবন করতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক  সাংবাদিক