খালেদা জিয়ার ভ্রান্তিবিলাস

খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন
খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন

খালেদা জিয়ার গতকালের বক্তব্যের নতুন ইঙ্গিত হচ্ছে বিদ্যমান নির্বাচনী ও সংসদ গঠনব্যবস্থা পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করা। বলেছেন, সংসদে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ আনবেন। তিনি নির্বাচনকালীন সরকার চান। তবে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংসদ ও নির্বাচনপদ্ধতির যুগোপযোগী সংস্কার নিয়ে আলোচনা চান না।
মনে হচ্ছে, বিধ্বস্ত বিএনপির নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখতে ভাষণটিকে একটি ক্ষমতামুখী মেজাজ দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু নিজেকে কিংবা দলকে বদলানোর ইঙ্গিত দিলেন না। তাঁর দলের গণতন্ত্র যে মৃত, তা তিনি দেখেননি। এই ভাষণ তাই ভীষণ হতাশ করেছে।
খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘নির্বাচনের নামে গত ৫ জানুয়ারির আওয়ামী প্রহসন হাতে-কলমে প্রমাণ করেছে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি কতটা যৌক্তিক। প্রমাণ হয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ হতে পারে না।’ তাঁর এ বক্তব্যে নতুনত্ব নেই।
কুড়ি দফা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সকলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা অস্থায়ী রূপরেখা নির্ণয় করা হবে।’
আমরা জানতে চাই, এটা তিনি ক্ষমতায় গিয়ে করবেন, নাকি আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকারের সঙ্গে ‘স্থায়ী রূপরেখা’ নিয়ে কথা বলবেন। যদি তিনি নিজে ক্ষমতায় গিয়ে ‘স্থায়ী রূপরেখা’ দিতে চান, তাহলে তাকে ‘অস্থায়ী রূপরেখা’ দিতে হবে। তবে স্থায়ী বা অস্থায়ী যে ধরনের রূপরেখাই হোক না কেন, তিনি মানবেন যে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতা হতেই হবে।
তাঁর সংক্ষিপ্ত রূপরেখার কিছু বিষয় তিন জোটের রূপরেখায় ছিল। লক্ষণীয় যে, তিনি এরশাদ ও গৃহপালিত বিরোধী দল সম্পর্কে টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করেননি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ‘ত্যাগ-তিতিক্ষা’র কবর তাঁরা দুজনে মিলে কীভাবে রচনা করেছেন, সেদিকে তিনি যাননি। তাঁর সুলিখিত ভাষণ সরকারে গিয়ে কী করবেন, তার একটি ফিরিস্তি মনে হয়েছে।
তাঁর ৫ নম্বর ঘোষণা: ‘নির্বাচনপদ্ধতির যুগোপযোগী এবং সংসদে শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিত্ব এবং মেধাবী, যোগ্য ও দক্ষ নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ ৯ নম্বরে বলা হয়েছে, ‘দেশের সকল মতের কৃতী ও মেধাবী নাগরিকদের রাজনীতি, সরকার পরিচালনা ও জাতীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি ও এর জন্য উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তোলা হবে।’
বিএনপির চেয়ারপারসন যদি এর মধ্য দিয়ে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন, প্রত্যক্ষ ভোটে নারীদের সংসদে আনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, ‘টক শোওয়ালা’ কিংবা ‘সিঁধেল চোরদের’ সংসদের উভয় কক্ষে আনার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন, তাহলে তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন, এই বাস্তবতা বাংলাদেশে এখন অনুপস্থিত যে শুধু এই কথায় চিঁড়ে ভিজবে। তিনি যখন রাজনীতিতে এসেছিলেন তখনকার তাঁর লিখিত বক্তৃতা খুঁজলেও পাওয়া যাবে ‘বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হবে কিংবা স্থানীয় সংবাদব্যবস্থাকে কার্যকর ও শক্তিশালী করা হবে।’
মনে হচ্ছে, তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে নবম সংসদ বয়কট করে চলার পরে তাঁকে বাদ দিয়ে দশম সংসদ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার মতো বাংলাদেশের পরিবর্তিত বাস্তবতা তিনি বিবেচনায় নিতে বেশ খানিকটা অপারগ থেকেছেন।
তিনি আগের মতোই অলংকারবহুল বাণী, যাকে সস্তা রাজনৈতিক বুলি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তেমন পরিভাষা ব্যবহার করার প্রবণতা পরিহার করতে পারেননি। যেমন বলেছেন, ‘নির্ভেজাল গণতন্ত্রই হবে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি।’
তিনি স্বীকার করবেন যে বর্তমান সরকারকে ‘সংবিধানের অপব্যাখ্যাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর নিজের লোকসান হ্রাস করা যাবে না। যদি স্বীকার করতে হয় যে, ‘৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে গণতন্ত্র আরেকবার নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন মৃত।’ তাহলে তাঁকেও স্বীকার করতে হবে যে তাঁর ভন্ডুল হওয়া ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ সফল হলেও তাতে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ ঘটত না।
আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে শবযাত্রা চলছে তার দায় কমবেশি প্রধানত উভয়কেই গ্রহণ করতে হবে। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট এবং ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস উভয়ে বলেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশ হেরে গেছে। সেই অর্থে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিশ্চয় এখন মৃত কিংবা কোমায়। কিন্তু সেটা অবশ্যই খালেদা জিয়ার ব্যাখ্যা ও তাঁর সংকীর্ণ দর্শন অনুযায়ী নয়। তাঁর মন্তব্য, ‘এ দেশের মানুষ তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রকে বেছে নিলেও বারবার এখানে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে।’ তিনি এর ব্যাখ্যা দেননি। তবে আমরা বেশ বুঝতে পারি, এর মাধ্যমে তিনি বস্তুত চতুর্থ ও পঞ্চদশ সংশোধনীকে ইঙ্গিত করেছেন। গণতন্ত্রের চলতি শবযাত্রায় তাঁর নিজের বা তাঁর দলের কোনো দায় তিনি স্বীকার করেননি। এবং এ-ও বুঝতে পারি, বিএনপির কেউ এত বড় শোচনীয় পরাজয়ের পরও পদত্যাগ করবেন না। তাঁর পুরো লিখিত বক্তৃতা পাঠ এবং সেখানে ঢুকে পড়া দলীয় কর্মীদের করতালি মুখরিত সংবাদ সম্মেলনে তাঁর উৎফুল্ল উপস্থিতি মনে হয়েছে, তিনি নিজেকে অভ্রান্ত মনে করেন। কোনো কিছুর জন্যই যেন অনুশোচনা নেই।
২০০১ সালের নির্বাচনের পরও তিনি আভাস দিয়েছিলেন, তিনি অতীতের দিকে তাকাবেন না। রিকনসিলিয়েশন করবেন। সে চেষ্টাও তিনি করেননি। সুযোগ পেলে, সুযোগ সৃষ্টি করে তিনি বঙ্গবন্ধুর নিন্দা করেন, শ্রদ্ধা জানান না। প্রতিপক্ষের কাছে যেসব বিষয় সন্দেহাতীতভাবে স্পর্শকাতর, সেসব বিষয়ে তিনি সতর্ক হন না।
তাঁকে অবশ্যই ১৫ ও ২১ আগস্ট সম্পর্কে তাঁর দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রতিপক্ষের জন্য কেবল নয়, নতুন প্রজন্মকে দূষণমুক্ত রাখতেও। তাঁর টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার দিনে যে শিশু জন্মেছিল, সে ২৩ পেরিয়েছে। খালেদা জিয়া যথার্থ বলেছেন, ‘বিরোধী দলকে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হবে। ক্ষমা, ঔদার্য, মহানুভবতা, যুক্তিশীলতা দিয়ে নির্ধারিত হবে বিরোধী দলের প্রতি আচরণ। সমঝোতার ভিত্তিতে হানাহানি ও সংঘাতের রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা ফিরিয়ে আনা হবে।’ এসব কথা ভোট টানতেই কি? আওয়ামী লীগকে জয় করতে চাইলে ১০ জানুয়ারির আগের অবিসংবাদিত মহান নেতার প্রতি যথাশ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো পূর্বশর্ত। ২০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মহান স্বাধীনতার ঘোষকের’ জন্মদিনে অনুষ্ঠান করবেন। ভালো কথা। সেখানেই নির্বাচনোত্তর সংকল্প অনুযায়ী ক্ষমা, ঔদার্য, মহানুভবতা, যুক্তিশীলতার প্রথম নজির স্থাপন করুন।
মসনদে গিয়েই কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঔদার্য ও মহানুভবতা দেখাবেন, সেটা কেবল প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকেই সম্ভব, এই বিভ্রান্তিমূলক চটকদার কথাবার্তা আর কাম্য নয়। তাঁকে ও তাঁর দলকে এখনই প্রমাণ দিতে হবে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি আগে কী করেছেন আর কী করবেন।
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি এবারই প্রথম একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হামলার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘এখন যদি এসব পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আগামীতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং প্রয়োজনবোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে সকল অপরাধীকে চিহ্নিতকরণ ও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।’ এটা যদি তাঁর সত্যিকারের অবস্থান হয়ে থাকে তাহলে বর্তমান নিয়মরক্ষার সরকারকে বলব, খালেদা জিয়ার এ মডেল এখনই গ্রহণ করতে। ২০০১ সালে নির্বাচনের পরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের ওই মডেল প্রয়োগ করুন।
বর্তমান সরকার খালেদা জিয়ার কথায় বিপজ্জনক সরকার। কিন্তু তাঁকে এটাও মানতে হবে, গণতন্ত্রের জন্য বিএনপিও বিপজ্জনক। ‘৫ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ আবার পিছিয়ে পড়ল। পুরোপুরি গণতন্ত্রহীন হয়ে পড়ল।’ এই কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি নিশ্চয় মনে করবেন যে, ৫ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই অগ্রসরমাণ বাংলাদেশে তাঁর ভূমিকাও জানা জরুরি। কেন তিনি জনগণের নির্বাচিত সংসদকে বয়কট করেছিলেন?
বাস্তবতা হলো দুই দল ও তার নেতা-নেত্রীরা আইনের শাসন ও সুশাসন দিতে পদ্ধতিগতভাবে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলা খেলছিলেন। সেই খেলায় বিএনপি এবার যোগ দিতে না পারার পরিণতি হলো বাংলাদেশের পুরোপুরি গণতন্ত্রহীন হয়ে পড়া। অনেকেই মানবেন, ‘একটি অবৈধ সরকারের কোনো দায়িত্ববোধ থাকে না জনগণের প্রতি। এমন একটি সরকার দীর্ঘায়িত হওয়া খুবই বিপজ্জনক।’ কিন্তু অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চাবিমুখ বিরোধী দলের অস্তিত্ব দীর্ঘায়িত হওয়াটাও কম বিপজ্জনক নয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম নির্বাচনসর্বস্ব দেখাটা এক বিরাট ভ্রান্তিবিলাস।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]