'মেড ইন বাংলাদেশ'...কিন্তু

গত সপ্তাহে পত্রিকার খবরে দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ায় পলিন হ্যানসনের ‘ওয়ান নেশন’ পার্টির সমর্থকেরা যে টি-শার্ট পরেন, তাতে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। স্থানীয় শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা যে দলের প্রধান নীতি, তাদের কর্মীরা পরছেন ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ টি-শার্ট। তাই এ নিয়ে একটু হইচই হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো কি, বাংলাদেশের টি-শার্ট দামে-গুণে-মানে সামনে চলে এসেছে।

এর আগে মে মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী প্রার্থী ম্যারি লো পেন বাংলাদেশে তৈরি টি-শার্ট ব্যবহার করেছেন। আর গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টিভি সাক্ষাৎকারে এলেন বাংলাদেশের তৈরি টি-শার্ট পরে।

বাংলাদেশের পোশাক বিদেশে সমাদৃত। কিন্তু দেশে যাঁরা সেসব পোশাক তৈরি করেন, সেই শ্রমিকেরা কেমন আছেন? তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা-ঝুঁকি কতটা নিশ্চিত করা হচ্ছে? তাঁরা কি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন? এর উত্তর কিছুটা ‘হ্যাঁ’। আর বেশির ভাগই ‘না’।

কিছু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের জন্য একটু সুযোগ-সুবিধা আছে। আইনেও বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধার কথা বলা আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আইন কার্যকর হয় না।

মাস তিনেক আগে বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। আইএলও, সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি উন্নয়ন-সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতিরাও ছিলেন। সবার আলোচনার মূল বিষয় ছিল, কীভাবে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্ভুক্ত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এখন নিয়মকানুন মেনে তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান প্লাটিনাম সার্টিফায়েড, যা আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশের জন্য মর্যাদা এনে দিয়েছে।

কিন্তু প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। একদিকে যেমন বড় ও সফল শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, তেমনি আবার এমন প্রতিষ্ঠানও আছে, যেখানে শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হন।

একজন শ্রমিকের মজুরি কত হওয়া উচিত, তাঁদের পেশাগত কাজের পরিবেশ কেমন হওয়া উচিত, এসব বিষয়ে প্রায় দেড় শ বছর আগে কার্ল মার্ক্স তাঁর বিখ্যাত ক্যাপিটাল বইতে লিখে গেছেন। তখন বিলাতে শিল্পবিপ্লবের যুগ। মালিকদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, মুনাফা বাড়াও। তাতে শ্রমিকের কী হলো না হলো, তাতে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু কার্ল মার্ক্সই প্রথম ব্যাখ্যা করে বললেন, একজন শ্রমিক আট ঘণ্টা শ্রম দিয়ে যে পণ্য উৎপাদন করেন, তার মূল্য (ভ্যালু) সেই পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এটাকে তিনি বললেন ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ (সারপ্লাস ভ্যালু)। কোনো পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল, মেশিনপত্র, জ্বালানি, অফিস খরচসহ আরও যা খরচ
সব ধরার পর একজন শ্রমিকের সংসারের সদস্যদের নিয়ে একটু ভালো পরিবেশে বসবাস, নিজের ও পরিবারের সবার মোটামুটি ভালোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার খরচ যোগ করার পরও সৃষ্ট পণ্যের দাম বেশি। দামের এই বাড়তি অংশটাই মালিকের পাওনা। মালিকের লাভ।

কার্ল মার্ক্স পরিষ্কার দেখিয়ে দিলেন, শ্রমিকের ভালো বেতন, তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য, খাদ্য-পুষ্টি, শিক্ষা, ঘরভাড়াসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় ব্যয় মোটামুটি বাজারদর অনুযায়ী মজুরি হিসেবে দেওয়ার পরও মালিকের মুনাফা বেশ ভালোই থাকে এবং তিনি দেখালেন, ভালো মজুরি শ্রমিকের প্রাপ্য। কারণ, শ্রমিক যদি সপরিবারে খেয়ে-পরে ভালোভাবে থাকতে না পারেন, তাহলে শ্রমিক বাঁচবেন কীভাবে? আর শ্রমিকই যদি না থাকেন, মালিকের কারখানা চালাবে কে?

কার্ল মার্ক্স দেখালেন, শ্রমিকের কাজের পরিবেশ যদি উন্নত হয়, যদি তাঁর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার দিকে নজর দেওয়া হয়, তার জন্য যে খরচ হবে, তাতে মালিকের মুনাফায় টান পড়ার কোনো কারণ নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে পণ্য উৎপাদনে ‘সারপ্লাস ভ্যালু’ ক্রমাগত বাড়ছে। সুতরাং মালিক যদি শ্রমিকের জন্য একটু বেশি ব্যয় করেন, তাহলে সেটা তাঁর শিল্পের টেকসই উন্নয়নে কাজে লাগবে।

দেড় শ বছর আগে যেটা কার্ল মার্ক্স বুঝেছিলেন এবং শ্রমিকদের স্বার্থের কথা বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, সেটা আজও বাংলাদেশের অনেক কারখানার মালিক বুঝতে চান না। যদি বুঝতেন, তাহলে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি হতো না। আজ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর অনেক কারখানা এসব দিকে নজর দিয়েছে। অনেক কারখানা এখন ‘কমপ্লায়েন্ট’ বা ‘উপযুক্ত মানসম্পন্ন’। বিদেশি ক্রেতারা আসছেন। যদিও অবশ্য এখনো সমস্যা আছে। অনেক কলকারখানা এখনো মানসম্পন্ন নয়। চেষ্টা চলছে উন্নত করার।

অন্যদিকে যদি আমরা ভবন নির্মাণ, জাহাজ কাটা, শহরের লেদ মেশিন ফ্যাক্টরি, বাসের হেলপার বা এ ধরনের কাজের কথা চিন্তা করি, তাহলে বলতে হয়, তাঁদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা আমলেই নেওয়া হয় না। ১২-১৪ ঘণ্টা একটানা কাজ। মাঝে হয়তো সামান্য খাওয়ার বিরতি। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়, অসুখ-বিসুখ, এসবের জন্য শ্রমিকদের প্রতি নিয়োগকর্তার যে কোনো দায়দায়িত্ব থাকতে পারে, সেটা অনেক ক্ষেত্রে স্বীকারই করা হয় না।

আমাদের শ্রম প্রতিমন্ত্রী সেই গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় পরিষ্কার বলে গেছেন, কোনো কারখানায় ৫০ জন শ্রমিক
থাকলে একজন চিকিৎসক থাকতে হবে। এর চেয়ে বেশি একটি নির্দিষ্টসংখ্যক শ্রমিক থাকলে একটি ক্লিনিক থাকতে হবে, ২০ জনের বেশি নারী শ্রমিক থাকলে পরিচর্যার জায়গা থাকতে হবে। এগুলো সরকারি আইন। মালিকেরা মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু অনেক কারখানায় মানা হয় না।

এই যে মানা হয় না, তা দেখবে কে? কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে লোকবলের অভাব। দক্ষতার অভাবও আছে। কিন্তু আমাদের তো এগিয়ে যেতে হবে। আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য কলকবজা, ভূমি, আসবাব, ভবন ইত্যাদিকে যেমন প্রাধান্য দেওয়া হয়, তেমনি শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়কেও প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। টেকসই শিল্পের জন্যই এটা দরকার।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছি। কিন্তু শ্রমিকদের বাদ দিয়ে তো আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। তাঁদের মজুরি-ভাতা যেমন চলতি বাজারদর অনুযায়ী হতে হবে, তেমনি তাঁদের কাজের পরিবেশও উন্নত হতে হবে। যেন আর কোনো ভবন ধসে না পড়ে। যেন আগুনে পুড়ে কোনো শ্রমিককে জীবন দিতে না হয়।

এখনই আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।

বিদেশে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ আর দেশের ভেতর ‘সাফার ইন বাংলাদেশ’ তো একসঙ্গে চলতে পারে না।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক