বিশ্বাস ও সন্দেহকাল

‘সদা সত্য কথা বলিবে’ ও ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’ দুটি সৎ উপদেশ। অত্যন্ত প্রাচীন বয়সী। আদেশ, নির্দেশ ও হুকুম মানায় অভ্যস্ত মানুষের মধ্যে উপদেশ মান্য করার আগ্রহ তেমন থাকে না। মহামূল্যবান কথা তাই বিশেষণসর্বস্ব, ঢাল–তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারের মতো।

সত্য-মিথ্যার চেয়ে চাওয়া ও পাওয়া এই সময়ের অনেক মানুষের কাছে অধিক মূল্যবান। তবে যারা বিশ্বসংসারে অপেক্ষাকৃত নবাগত, বড় হওয়ার পথে পা রেখেছে যারা, তারা ভিন্ন রকম। পাপ বা পুণ্য নিয়ে তাদের মাথা ঘামানো নেই, ন্যায় ও অন্যায় নিয়ে বিস্তর চর্চা নেই। তারা চরিত্রে, স্বভাবে স্বাভাবিক। কথা, মনের ভাব প্রকাশে সোজাসাপ্টা। অন্যে কী মনে করবে মাথায় রেখে তারা চলে–বলে না। ভান-ভণিতাও তাদের অচেনা, অজানা। সত্য বলা উচিত, সত্যই বলে তারা।

জগৎসংসারে অধিক কাল আগে আগমনের সুবিধাভোগীরা দুনিয়াদারির রকমসকম বোঝে। জগতের রীতি–নীতি বুঝে–শুনে চলা ও বলার সুযোগ মিলেছে তাদের। ভালো থাকার কায়দাকানুন, গা বাঁচানোর নানা কৌশল রপ্ত করে পোক্ত হয়েছে তারা। সব মন্দই তাদের চোখে মন্দ নয়। শঠতা, ভান-ভণিতা, তোষামোদি সবই এখন বিষমুক্ত আমের মতো। নতুন রূপে সেই সব হয়ে উঠেছে জীবন উন্নয়নের চাবিকাঠি।

মানুষ মনে করে, জীবনে প্রভূত উন্নতি দরকার। উন্নতি মানে টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি। সেসব যত হবে, ততই সম্মান। ততটাই বাড়বে মান-মর্যাদা। প্রতিপত্তি বাড়লে আশপাশে হাত কচলাকচলি করা মানুষ বাড়ে। পানির মতো সহজ হয়ে যায় ইচ্ছাপূরণ। দোষ আর দোষ থাকে না। বিত্তবৈভবের অনেক জোর, খারাপ নজর গায়ে লাগতে দেয় না। লোকসানের ভয়ডর কাটিয়ে মজবুত, সাহসী করে তোলে। লাভ, উন্নতির বেলায় কিসের, কতটুকু অধঃপতন ঘটল, সেই হিসাব তত দরকারি বলে মনে হয় না। এসব পোক্ত মানুষের সওদাগরি নজর সর্বদা লাভ-ক্ষতির দিকে মুখিয়ে থাকায় জগতের গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক কিছুই তাদের অদেখা থেকে যায়। এই ধরাধামে যারা নতুন, তারা যে ভিন্নতর চিন্তাচেতনার, সেই বিষয়টি তাদের অজানা থেকে যায়। এই নতুন প্রজন্ম স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে বড়ই অপটু। বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজনীয় মনে করে, কিন্তু চালাকি তাদের অজানা। এই নতুন প্রজন্ম এখনো স্বার্থপরতার খপ্পরে পড়েনি। সততা, অসততা, নীতিনৈতিকতা—এসব বিষয়ের চর্চা ছাড়াই তারা সৎ, নীতিমান। নতুনেরা আছে অসংখ্য পুরোনোর অদেখা এক নতুন ভুবনে। সেখানে আছে বিস্ময়। রয়েছে কল্পনার অসীমতা, অশেষ সৃজনশীলতা। সেখানে সবকিছুই বৃহৎ। সেখানে গায়ের জোর, গলার জোর নেই। রয়েছে যুক্তি আর যুক্তি খণ্ডনের প্রক্রিয়া। সেখানে অযথা তর্ক নেই, বিতর্ক অসম্মানের নয়। সেই জগতে চোখ রাঙিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠা হয় না।

জগৎ বুঝে ফেলা এবং এর ছটফটানিতে আক্রান্ত মানুষ যেকোনো মূল্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা চায়। যেকোনো দোষের দায় নির্বিকারে ঠেলে চড়িয়ে দেয় সময়ের কাঁধে। সময়ই যেন সবাইকে শত মন্দে বাধ্য করে চলেছে। স্বার্থবাদী পুরোনোরা পাল্টে দিয়েছে দায়িত্ব-কর্তব্যের সংজ্ঞা, সত্য-মিথ্যার মানেও। চোখ কপালে তোলা মিথ্যায় বাহবা মিলছে। নিজের অন্যায় অন্যায় নয়, অপরের অন্যায়ে হালুম হুলুম নিত্য দৃশ্যমান। এসবের অনুশীলনে সুস্থতা, স্বাভাবিকতা বেহাল। নিঃশব্দে বাড়ছে হতাশা। হতাশা জন্ম দিচ্ছে বিশ্বাসহীনতা। যেকোনো ঘটনার মুখোমুখি হলে মগজে মোচড় দিয়ে ওঠে অবিশ্বাস, সন্দেহ।

চিকিৎসকের চিকিৎসায় রোগীর সন্দেহ। হাসপাতালের সেবায় সন্দেহের কারণ মিলছে। ওষুধে সন্দেহ; খাদ্য, পানীয়, অভাব ও স্বভাবে সন্দেহ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভূমিকায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে সন্দেহ, অবিশ্বাস। মানুষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভালো আচরণও এখন সন্দেহমুক্ত নয়। লেখা, বলা, চলা দায়িত্ববোধের পরিচয় সবকিছুর পেছনে অন্য কারণ খোঁজার তাগিদ। পথে নামা মানুষকে সন্দেহ, পথে না নামা মানুষও সন্দেহমুক্ত নয়। প্রতিবাদে সন্দেহ, সমালোচনা ও প্রশংসাতেও সন্দেহ। এই সন্দেহের ঘনঘটায় থেকেও মানুষ, মানুষেরা বলছে ভালো আছে। বড়ই কৌতুকময় এবং করুণ এই সময়। কেউ ভালো আছে বললে সন্দেহ জেগে উঠছে, ভালো নেই বললেও সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। চুপ করে থাকলে সন্দেহ, মন খুলে বললেও সন্দেহ। আক্রান্ত হলে সন্দেহ, নিহত বা আহত হলে সন্দেহ। অপহৃত হলে সন্দেহ, উদ্ধার হলেও সন্দেহ। দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, মৃত্যু, হত্যা, গুম—সন্দেহ সবখানে। সন্দেহ আগুন লাগলে, সেই আগুন নিভলেও সন্দেহ। হাসিতে সন্দেহ, ফাঁসিতে সন্দেহ। সন্দেহ উচ্চ ও কম মূল্যে, সন্দেহ জাগে বিনা মূল্যেও। সন্দেহ গুণে, ধ্যানে, জ্ঞানে। পুরস্কারে সন্দেহ, সন্দেহ নিন্দায়। সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্য পালন—সবই সন্দেহের কবলে। বিশ্বাস ঝরে যাচ্ছে সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা থেকে। স্বার্থপরতা আপনকে করছে পর আর পরকে বানিয়ে দিচ্ছে আপন।

মানুষের এমন দশা অল্প দিনে নয়, হয়েছে বহু দিনে। একটু একটু করে জমতে জমতে অবিশ্বাস এখন পাহাড়প্রমাণ। কবে বিশ্বাসের দৃঢ়তায় আমাদের মহাঐক্য হয়েছিল কাউকে বলে দিতে হবে না। সেই গৌরবের কালে এক সত্যের টানে জীবন দেওয়ার জন্য সবাই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শুধু একাত্তরে নয়, অতীতে মেলে অসংখ্য উদাহরণ। মানুষ মানুষের জন্য পথে নেমেছে। মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে। এখন দাঁড়ানোর আগে হিসাব কষে নেয়। দাঁড়ায় নিজ স্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে। বাড়াবাড়ি রকমের স্বার্থপরতার চক্করে আপন আপন অস্তিত্ব হয়েছে কমজোর। সন্দেহ, অবিশ্বাসে তা বল পায়।

হোলি আর্টিজান আমাদের জীবনে এক দুঃখজনক অধ্যায়। এ ধরনের ঘটনা আমাদের যেমন উদ্বিগ্ন করে, মনে শঙ্কা জাগায়, অনিরাপদবোধে ভোগায়—ঘটেছে তেমনই। পাশাপাশি শোক–শঙ্কা ছাপিয়ে কষ্টকল্পনা, অসংখ্য প্রশ্নের উৎপাতে অতিষ্ঠ হওয়াও চরিত্র অনুযায়ী চলেছে। অদরকারি প্রশ্ন, অশোভন কৌতূহল, অশালীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এখানে-ওখানে বুদ্‌বুদের মতো জেগে উঠেছে। সেই সব বুদ্‌বুদ স্বল্পায়ু হলেও স্বস্তিকর নয়।

হোলি আর্টিজানের ঘটনায় অনেককেই প্রাণ দিতে হয়েছে। নির্মমতায় যাদের এই পৃথিবী ছাড়তে হলো তারা চেনা হোক বা অচেনা, তাদের জন্য কষ্ট জাগে। যারা নিজ ভাষা ও দেশের, তাদের জন্য কষ্টের পরিমাণ বেশি হবে, সে–ও অস্বাভাবিক নয়। যারা বয়সে ছোট ছিল, তাদের জন্য আলাদা মায়া, বেদনা অনুভবও খুব স্বাভাবিক। পরিচয় জানাশোনা না থাকলে টুকরো টুকরো কথায় তাদের সঙ্গে চারপাশের চেনাজানা অনেক ছোটর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অবিন্তা, ফারাজ, তারিশি, ইশরাত কেউই অচেনা থাকে না। জানা যায়, হত্যাকারীরা ফারাজকে ছেড়ে দিতে চাইলেও তার অন্য বন্ধুরা সেখানে আটকা পড়ে থাকবে বিবেচনা করে একা ফিরে আসতে অস্বীকার করেছিল এই সামান্য বয়সী অসামান্য তরুণ। পুরোনো এই পৃথিবীতে বহুকালের বাসিন্দা নয় বলে একই বয়সীদের মতো তার ভেতরেও স্বাভাবিকতা অটুট ছিল। এ রকম অসাধারণ নিঃস্বার্থ চিন্তার প্রকাশে সব মানুষেরই দুঃখের ভেতরে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার কথা। এ তথ্য বহু সাধারণের জন্য বিস্ময়ের, গৌরবের। এই গৌরব বহুজন বহু স্থানে আনন্দের সঙ্গে ভাগাভাগি করে সুখী হয়, সম্মানিত বোধ করে। পাশাপাশি অনেককে শুনতে হয়েছে সন্দেহ মেশানো প্রশ্ন। সত্যিই কি তাই?

এই সন্দেহ চর্চার বিষয় নয়। দুঃখের ও বেদনার বিষয়, সংকীর্ণতা, যা দীর্ঘকাল ধরে মন্দচর্চার বেদনাদায়ক ফলশ্রুতি। মনে তা বিষক্রিয়ার মতো। সন্দেহ, দোষারোপের সংস্কৃতি দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাতচল্লিশ বছরে একে অন্যের দিকে আঙুল তুলতে তুলতে অসংখ্যের প্রতি অজস্রের অবিশ্বাস কেবলই বেড়েছে। মানুষ টুকরো হয়েছে, হয়েছে শক্তিহীন। জন্ম নিয়েছে গা বাঁচানো সংস্কৃতি, স্বার্থপরতা, বিশ্বাসহীনতা।

এই প্রচণ্ড অবিশ্বাসের অন্ধকার ফুঁড়ে এক নতুন প্রজন্মের প্রবল মাথা তুলে দাঁড়ানো অনেকেই প্রত্যক্ষ করে না। এই প্রজন্ম নির্মোহ। সদা স্বার্থপর এক সমাজ ও কালে জন্মগ্রহণ করেও নিঃস্বার্থ তারা। উদারতা, মহত্ত্ব প্রমাণের আকাঙ্ক্ষা তাদের নেই। তারা স্বাভাবিকতায় সুন্দর, তারা প্রাকৃতিক। খুঁজে পেতে চাইলে প্রত্যেকের চারপাশে অগণিত ফারাজকে পাওয়া যাবে, যারা এ রকম পরিস্থিতির শিকার হলে বন্ধুদের ছেড়ে আসতে চাইবে না। তারা বেঁচে থাকা বলতে মর্যাদাপূর্ণ বেঁচে থাকা বোঝে। হিসাবি, স্বার্থবাদী পূর্বজনেরা যা বহু আগে পরিত্যাগ করেছে।

আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক, নির্দেশক।