জামায়াতের ভাবাদর্শ

রাজনৈতিক সংঘাতের সময় জামায়াতের কর্মীদের লাঠি হাতে বিক্ষোভ
রাজনৈতিক সংঘাতের সময় জামায়াতের কর্মীদের লাঠি হাতে বিক্ষোভ

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো সংঘবদ্ধ বা আধা সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও দমন-পীড়নকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে অভিহিত করার একটি রেওয়াজ চালু আছে। কিন্তু যে মুহূর্তে ব্যাপারটিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলা হলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি বিষয় তলিয়ে যায় যে এ ধরনের আক্রমণ একেবারেই একপক্ষীয়। অপরপক্ষ যেহেতু কোনো ধরনের পাল্টা আক্রমণে যেতে অক্ষম, সেহেতু পুরো ব্যাপারটা কখনোই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয় না। আর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কখনো হয়নি বলে কিছু মানুষ দেখানোর চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খুব সুখে আছে। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টো। দীর্ঘ সময় ধরে তারা পদ্ধতিগত নির্যাতনের শিকার। আর এই পদ্ধতিগত নির্যাতনের নেতৃত্বে থাকা সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির।
১৯৭১ সালের জুন মাসে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন যে বাংলাদেশে যে ঘটনাটি ঘটে চলেছে, সেটা পুরোদস্তুর একটি গণহত্যা। আর সেই গণহত্যার প্রথম প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ‘হিন্দু নিধন’। পাঠক, নিশ্চয়ই সেই আলোকচিত্রটি দেখেছেন, যেখানে লুঙ্গি পরা একজন পথচারীকে তাঁর ধর্ম-পরিচয়ের ‘সত্যিকারের পরীক্ষা’ দিতে হয়েছিল লুঙ্গির গিঁট খুলে। সে সময়কার নিধনযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে বহু হিন্দু শুধু তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় মুছে ফেলেই বাঁচার চেষ্টা করেননি, নামও বদলে ফেলেছিলেন। আর সেই নিধন প্রক্রিয়ার অন্যতম অংশীদার ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। তারা ব্যাপারটি ঘটিয়েছে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার নামে, ইসলামের নামে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে শুরু হয় নজিরবিহীন নির্যাতন। লুণ্ঠন, বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পোড়ানো, মারধর ও ধর্ষণ চলেছে নির্বিচারে। আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে এই নির্যাতনকারী আর ১৯৭১ সালের নির্যাতনকারীরা একই দলের অনুসারী। তবে এ ক্ষেত্রে দলটি তার রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় পুরো ব্যাপারটি ঘটিয়েছিল। আবার ২০১৩ সালে যখন ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যায় ও মানবতার বিরুদ্ধে জড়িত অপরাধকারীদের দণ্ডিত করা হলো, তখন সেই দলটি রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে আবার তাদের পুরোনো এবং হিংস্র খেলায় মেতে ওঠে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া আগের মতোই নির্বিচারে চালায়। সঙ্গে নতুন যোগ হলো হিন্দুমন্দিরগুলো ভেঙে ফেলার তাণ্ডব। ২০১৪ সালে দশম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর দলটি আবার চড়াও হয় দেশের আনাচকানাচে বসবাসরত হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ সংগঠনটি বিএনপির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ পেয়ে এসেছে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে ক্ষেত্রবিশেষে বর্তমান শাসক দলের কর্মীরাও এ ধরনের অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িয়েছেন।
জামায়াত যত দিন যাবৎ বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তত দিন যাবৎ তারা ক্রমাগতভাবে প্রমাণ করে যাচ্ছে যে কারণে-অকারণে মানুষের, বিশেষ করে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর চড়াও হওয়া তাদের সহজাত। আর এ কাজটি তারা করে কখনো ইসলাম রক্ষার নামে; আবার কখনো ইসলামি ‘চিন্তাবিদ’ বা ‘নেতা’কে রক্ষার নামে।
পাঠক, নিশ্চয়ই বিস্মৃত হননি যে আবদুল কাদের মোল্লা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার আগে এবং পরে পুরো সময়টা জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল যে অন্য এক কাদের মোল্লার অপরাধে জামায়াতের ‘নিরপরাধ নেতা কাদের মোল্লা’র ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু তাদের পুরো ব্যাপারটা মাঠে মারা যায়, যখন তাদের মূল সংগঠন ‘পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামি’ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ বিবৃতি দিল যে আবদুল কাদের মোল্লাকে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের জন্য ঝুলতে হলো।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ ক্রিয়াশীল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের নিজস্ব মত প্রকাশ করার এবং নিজস্ব মতাদর্শ অনুযায়ী দল ও সংগঠন পরিচালনা করার অধিকার থাকে। সে বিবেচনায় জামায়াতেরও রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এ অধিকার কি নিরঙ্কুশ? কোনোভাবেই নিরঙ্কুশ নয়। যে মতাদর্শ ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার সমান অধিকার-মর্যাদা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী নয়, সে ধরনের মতাদর্শ প্রচার-প্রসারকে শুধু পরিত্যাগ করাই নয়, সেগুলোকে সমাজদেহ থেকে সমূলে উপড়ে ফেলার মধ্যেই সর্বজনীন কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। আর তাই নাৎসিবাদ আজ সর্বজনীনভাবে পরিত্যাজ্য। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই নাৎসিবাদকে তার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে কোনো রূপেই বরদাশত করবে না। ফলে ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গের যেকোনো মত বা মতাদর্শকেই রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াটা ন্যায্য হতে পারে না। যে জামায়াতের কর্মকাণ্ড ইসলামের নামে পরিচালিত হয় বলে কথিত, সেই ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জীবনের শেষ ভাষণেও তিনি অন্যের জান-মালের পবিত্রতা ও নিরাপত্তা রক্ষার তাগিদ দিয়ে গেছেন। আর জামায়াত ইসলামের মহান আদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে ক্রমাগতভাবে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। তাই নাৎসি ভাবাদর্শের মতো জামায়াতি ভাবাদর্শের ব্যাপারেও আমাদের চিন্তা করার সময় এসেছে।
কেউ কেউ এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। যুক্তি দেখাতে পারেন যে জামায়াতের কোনো অতি উৎসাহী কর্মী বা সমর্থক যদি ব্যক্তিগতভাবে সংখ্যালঘু নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁর সংগঠনকে কেন দায়ী করাটা ন্যায্য হবে না। তাদের জেনে রাখা উচিত যে জামায়াত একটি সংগঠন হিসেবে ঐতিহাসিকভাবেই ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি এহেন মারমুখী আচরণ করে আসছে। জন্মের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই জামায়াত পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু আহমদিয়া মতাবলম্বীদের ওপর। এ জন্য এর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীকে বিচারপতি মুনির হোসেন কমিশন দায়ীও করেন। সেই দাঙ্গার দায়ে মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, যদিও তা কার্যকর হয়নি।
তারপর জামায়াত চড়াও হয় পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর। আর স্বাধীন বাংলাদেশে এর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। শুধু ইহুদি নিধনে জড়িত থাকার অপরাধে যদি নাৎসিবাদকে পৃথিবী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে
দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর পদ্ধতিবদ্ধ নির্যাতনের অভিযোগে জামায়াতি ভাবাদর্শকেও তেমনি গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে ‘পরিত্যাজ্য’ বলে ঘোষণা করা উচিত। এমন ‘বিদ্বেষপ্রবণ’ ভাবাদর্শকে ‘ক্রিয়াশীল’ হতে দেওয়াটা বাহাদুরির নয়, বরং চিন্তার বৈকল্যের লক্ষণ।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কর্তব্য ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সব নাগরিকের জান-মাল-ইজ্জত-সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একইভাবে রাষ্ট্রের কর্তব্য পালনে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাদের ব্যাপারে কঠোর হওয়াও তার দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে নাৎসি ও জামায়াতের মতো বিদ্বেষসর্বস্ব সংগঠনগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য শুধু রাষ্ট্রযন্ত্র যথেষ্ট নয়; এর সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।
মামুন আল মোস্তফা: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]