এটা যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতা না হয়

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করে নির্বাচন কমিশন
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করে নির্বাচন কমিশন

গত ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গত ১৬ জুলাই একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সাতটি প্রধান বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে একটি কর্মপরিকল্পনা লিখিত আকারে প্রকাশ করে। এই কর্মপরিকল্পনা ‘রোডম্যাপ’ বলে পরিচিত হলেও এটি ইসির কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তাদের পরিকল্পনার বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরেছে, যা ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। ২০০৮ সালের পর এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে বর্তমান ইসি যে পরিকল্পনা তুলে ধরেছে, তেমন কিছুই বিগত রকিব কমিশন করতে পারেনি, যার কারণে ২০০৮-এর হুদা কমিশনের একটি সফল উদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি এবং ওই কমিশন জনগণের কাছে স্বচ্ছ হওয়ার চেষ্টাই করেনি। এ ধারাবাহিকতার প্রয়োজন ছিল, যার ফলে তাদের কর্মকাণ্ড জনসমক্ষে তেমন প্রকাশ পায়নি। এ ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের উদ্যোগে আরও একটি জাতীয় নির্বাচনের আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং তার আইনি সংস্কারের বিষয়টি স্থান পায়নি। এই নির্বাচনগুলো দলীয়ভিত্তিক হওয়ার কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

যাহোক, কর্মপরিকল্পনার বিষয়ের ওপর সম্যক ধারণা অর্জনের জন্য ইসি বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সংলাপের পথটি বেছে নিয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করা হয়। ইসি যাদের সঙ্গে সংলাপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেসব সংগঠন বা ব্যক্তির সমষ্টি গণতান্ত্রিক বিশ্বে নির্বাচন পরিচালনা সংস্থার (ইএমবি) সহায়ক অংশীদার বলে স্বীকৃত। এরই ধারাবাহিকতায় নুরুল হুদার নেতৃত্বে ইসি গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা দিয়ে পরিকল্পিত ধারাবাহিক সংলাপের সূচনা করেছে। যদিও সংলাপের ধরনটি বিস্তারিত নয়, তবে ইতিবাচক হয়েছে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি। এ অনুষ্ঠান ছিল ইসির প্রথম জনসমক্ষে নিজেদের তুলে ধরার প্রয়াস। এ সংলাপের মাধ্যমে ইসি যেসব সুপারিশ পেয়েছে, তা খুব বিস্তারিত না হলেও বিক্ষিপ্তভাবে অনেক বিষয়ে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের কাছে থেকে সম্যক ধারণা পেয়েছে। এ প্রক্রিয়া আরও বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত হলে ভালো হতো। এখানে মোটাদাগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে, যার প্রতিফলন ঘটাতে ইসিকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব তৈরি করতে হবে।

যেসব প্রস্তাব সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, তার বেশির ভাগকে আইনি কাঠামোতে রূপান্তরিত করে পরবর্তী সম্মেলনগুলো আরও সুস্পষ্ট করতে হবে। এসব মোটাদাগের প্রস্তাবে বেশির ভাগই ইসির আমলে নেওয়ার মতো বিষয় রয়েছে এবং প্রস্তাবগুলো বহুল আলোচিত। বেশির ভাগই ২০১১ সালে তৎকালীন হুদা কমিশন এমনই সংলাপের মাধ্যমে তাদের মেয়াদ শেষের প্রাক্কালে সুপারিশ আকারে সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামোতে তৈরি করেছিল। যেসব মুখ্য বলে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, ওই প্রস্তাবে সব কটিরই অন্তর্ভুক্তি রয়েছে।

যদিও সদ্য সমাপ্ত সংলাপে আমন্ত্রিত প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন কারণে উপস্থিত হতে পারেননি, তবে তাতে আয়োজনের গুরুত্ব খর্ব হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই। প্রয়োজনে ইসি সুশীল সমাজের সঙ্গে সীমিত আকারে দ্বিতীয় দফা আলোচনার আয়োজন করতে পারে।

যে কয়েকটি বিষয় মুখ্য বলে বিবেচিত তথ্যে প্রকাশ, তার মধ্যে বেশ জোরালো সুপারিশ এসেছে জাতীয় সংসদ এবং প্রয়োজনে অন্যান্য নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও এর কার্যকারিতা, ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে ‘না-ভোট’-এর পুনঃপ্রবর্তন, নির্বাচনকালে নির্বাচনী ব্যয়ের পর্যবেক্ষণ এবং পরবর্তী পর্যায়ে নিরীক্ষণ, নির্বাচনে ইসির নিজস্ব জনবলের অধিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারই প্রাধান্য পেয়েছে। এর সঙ্গে সংগতভাবেই এসেছে ইসির নৈতিক ও আইনি ক্ষমতা। বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার ক্ষেত্রে এবং পেশিশক্তি নিয়োগের বিষয়। এমনকি সংসদীয় সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টিও তুলেছেন অনেকে। তবে বিষয়টি কারিগরি বিধায় তেমনভাবে উঠেছে বলে মনে হয় না।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উত্থাপিত দু-একটি বিষয়ের ওপর যৎসামান্য আলোচনার প্রয়োজন বলে মনে করছি। এ আলোচনায় আমার মতামত অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মিশ্রণে উপস্থাপিত করছি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টিতে আমাদের দেশের রাজনীতিতে সাংস্কৃতিক বিভাজনের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়, বিশেষ করে বাহিনীর কার্যকর নিয়োগের ক্ষেত্রে। সেনা মোতায়েন বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো নতুন বিষয় নয়। প্রথম থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় এবং অনেক স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সেনা মোতায়েন হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে মোতায়েন করা হয়েছে। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীকে আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, যা সম্ভবত ২০১০ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত অবস্থায় ছিল। ২০০৮ সালে অন্যান্য নির্বাচনের সংজ্ঞায়ও সংযোজিত হয়েছিল, যাতে ওই সব নির্বাচনের আইনের প্রয়োগে পুলিশ তথা অন্যান্য বাহিনীর মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। ২০১০ সালে শেষবার পৌরসভা নির্বাচনে এ সংজ্ঞা অনুযায়ী সেনাবাহিনী নিয়োজিত হয়েছিল। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার আওতায় রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণাধীন নিয়োজিত ও কর্মপরিচালনা করার সুস্পষ্ট বিধানের অধীন রাখা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়োগ ইসির নিয়োগ নীতির আওতায় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়।

প্রশ্ন দেখা দেয় সেনা নিয়োগের প্রয়োজনীয়তার বিষয়, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। উল্লেখ্য, প্রায় ১০ কোটি ভোটারকে এক দিনে ভোট দিতে হয়। প্রায় ৪০ হাজার কেন্দ্র এবং কয়েক লাখ বুথে এ ভোট গ্রহণ করা হয়। এক দিনের এই নির্বাচনে বেশ কয়েক স্তরের নিরাপত্তার প্রয়োজন, তার জন্য যে সংখ্যায় নিরাপত্তারক্ষীর দরকার, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, যে কারণে শক্তি বৃদ্ধির জন্য সেনাবাহিনীকে প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে যে পেশিশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিনই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় পেশিশক্তির বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে। কাজেই নির্বাচন কমিশনের প্রথম চিন্তাতেই নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। মাত্র বছর কয়েক আগে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতিতেও প্রায় ১১০ জনের প্রাণহানি এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছিল। নির্বাচন হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন। কাজেই নিরাপত্তার বিষয়টিকে কোনোভাবেই ছোট করা যায় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এটাই বাস্তবতা, যে কারণে অধিকতর বাহিনীর প্রয়োজন।

সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে নিয়োগের সপক্ষের আরেকটি বড় যুক্তি জনসাধারণের আস্থা। যেহেতু সামরিক বাহিনী জনচক্ষুর অন্তরালে থাকলে দুর্যোগে সর্বাগ্রে মানুষের পাশে একটি নিরপেক্ষ ফোর্স হিসেবে দাঁড়াতে দেখা যায় এবং অন্যান্য বাহিনীর ক্ষেত্রে, বেশির ভাগ সময় অধিকতর মানুষের আস্থার ভাটায় রয়েছে, সে কারণে সামরিক বাহিনী নিরপেক্ষ মানুষের আস্থার জায়গায় থাকায় তাদের উপস্থিতি মানসিকভাবে নিরাপত্তার সঞ্চার করে। নিরাপত্তার পরিবেশ ব্যাহত হলে নারী ভোটারদের উপস্থিতিতে ভাটা পড়ে। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটার নারী। কাজেই আমি মনে করি, সামরিক বাহিনীর কার্যকর উপস্থিতির প্রয়োজন রাজনৈতিক কারণে নয়, নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনের কারণেই কার্যকরভাবে নিয়োগ করা প্রয়োজন।

আমার বিবেচনায় আরেকটি বিষয় সুশীল সমাজের ৯০ শতাংশের সুপারিশে সামনে এসেছে তা হলো ‘না-ভোট’, যা ২০০৮ সালে প্রথম এ দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। যে বিধানটি ২০০৯ সালের আইনে বাতিল করা হয়েছিল। এই বিধানের বিপক্ষে প্রায় সব রাজনৈতিক দল এবং কিছুসংখ্যক মানুষ। কিন্তু তাদের যুক্তি খুব জোরালো নয়। এ বিধান যদি গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলে বিবেচিত হতো, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এ বিধানকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিত না। সে দেশেও রাজনীতিবিদেরা বিপক্ষে ছিলেন। গত নির্বাচন থেকেই ‘নোটা’ (নন অব দ্য অ্যাবভ) হিসেবে ব্যালটে যুক্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ‘না-ভোট’ একজন ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার, যা বাড়িতে বসে থেকে বা ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত থেকে অথবা ব্যালট বিকৃত করে অধিকার রক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই ভোটারদের এই মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে ওই রায় দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে না-ভোটের চর্চা থাকলে ২০১৪ সালে বিনা ভোটে ১৫৩ জন নির্বাচিত হতেন না এবং এই মনঃকষ্ট বহন করতে হতো না।

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এই দুটি বিষয়ে আমার মতামত পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম। এর মানে এই নয়, বাকি বিষয়গুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখার বিষয় হবে নির্বাচন কমিশন এসব বিষয় নিয়ে কী মতামত দেয় এবং কতখানি দৃঢ়তা দেখাতে পারে। যদিও আইন প্রণয়ন সংসদ ও সরকারের হাতে, তবু প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে, তবেই তাদের এসব উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। স্মরণযোগ্য যে এসব যৌক্তিক আইনি পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজনের সুপারিশ কমিশনের তৃণমূলের অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। কাজেই এসব সুপারিশ সুশীল সমাজেরই নয়, প্রায়োগিক ক্ষেত্র হলেও উঠে এসেছে। এখন দেখার বিষয় নির্বাচন কমিশন কীভাবে অগ্রসর হবে। আশা করি তাদের এ উদ্যোগ শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও তারা সেগুলো কার্যকর করার পদক্ষেপ নেবে।

সবশেষে নির্বাচন কমিশনের তাদের সহযোগীদের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।