দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ছাগলের বিবরণ

গরিবি হটাতে বা ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষকে একটা সাহারা দিতে ছাগল বিতরণ খুবই জনপ্রিয় একটি কর্মসূচি। অনেকটা কর্মসংস্থানের নামে সেলাই মেশিন বিতরণের মতো। একবার মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের আন্ধারমানিকের কাছাকাছি এক গহিন গ্রামে গিয়ে দেখি, সাতষট্টি বাড়ির সেই চরগ্রামে প্রায় সত্তরটি সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে—নারীর ক্ষমতায়নের নামে! সে আরেক কাহিনি। সম্প্রতি একটি নিরীহ প্রাণীর মৃত্যুতে সংশ্লিষ্ট সবাই যে পরিমাণ হয়রান হয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত সাতান্নোর কার্যপরিধিতে যে একটা লাগামের ব্যবস্থা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো রসালো আলোচনার জন্য এই লেখা নয়। এ লেখার প্রতিপাদ্য দুস্থদের মাঝে অসুস্থ ছাগল বিতরণের যে ট্র্যাডিশন দক্ষিণ এশিয়ায় তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কে একটু খোলাখুলি আলোচনা করা। এ ধরনের পেট খালি করা আলোচনার অভাবেই আগের আকবর হোসেন আর হালফিলের চন্দ বাবুরা বিপদে পড়েন। লঞ্চডুবিতে মৃত আর অর্ধমৃত মানুষের এবং তাদের পরিবারের মধ্যে ছাগল দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মন্ত্রী আকবর হোসেনকে কতই না কথা শুনতে হয়েছিল!

সদ্য রাজ্যের স্বীকৃতি পাওয়া ইন্ডিয়ার কনিষ্ঠতম রাজ্য তেলেঙ্গানায় এই ছাগল বিতরণ নিয়ে মহা ফ্যাসাদের সৃষ্টি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সব গরিব মানুষকে ছাগল দেওয়া হবে। এ ছাগল পেলে তারা তার দুধ খাবে, দুধ বেচবে, পালে পালে ছাগল বাড়বে, সংসারে সুখের নহর বইবে। কিন্তু এত ছাগল পাবে কোথায়। ইন্ডিয়া বড় দেশ, ছাগলের হাজার হাজার হাট, লাখ লাখ ট্রাকের বহর। সেসব হাটে কড়ি ফেললেই ছাগল এসে যাবে—আদিলাবাদ, নিজামাবাদ, মেহবুবনগর, নালগন্ডা বা খামানের মতো দূরবর্তী জেলায়। তারপরও গোল বেধেছে সেখানে। হাজার হাজার কাতর ছাগল মরছে অকাত‌রে, কেউ পানাহার বন্ধ করেছে, কেউ সারা দিন কান্নাকাটি করে উচ্চ স্বরে, মুখে নেয় না ঘাস-পাতা কিছুই।

আমাদের ছোট দেশেও এমনটি ঘটে। ছাগল কেন এমন করে? কেন তারা বিতরণের পরপরই মারা যায় কিংবা ধীরোতে ধীরোতে (ছাগলের ডায়রিয়া) কোমায় চলে যায়? প্রাণিবিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে ‘প্রজেক্ট’ পাওয়া সাপেক্ষে গবেষণা করে দেখতে পারেন। পারলে এ বিষয়ে থিসিস অ্যান্টি-থিসিস করা যায়। এ দেশের উন্নয়ন সংস্থাগুলোর দুর্যোগপরবর্তী কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে ছাগল বিতরণ একটি জনপ্রিয় কিন্তু প্রায় ব্যর্থ কর্মকাণ্ড। যাদের বাড়িতে এই প্রাণীটি প্রতিপালনের চর্চা বা ইতিহাস আছে, তাঁরা একটু চিন্তা করলেই এসব ব্যর্থতার কারণ খুঁজে পাবেন। কোরবানির খাসি ছাড়া গৃহস্থ এবং খামারিরা সাধারণত সুস্থ-সবল সম্ভাবনাময় ছাগল বিক্রি করেন না। বাজারে যেসব ছাগল আসে, তার অধিকাংশই প্রায় অবসরে যাওয়ার অপেক্ষায় কিংবা চূড়ান্ত অসুস্থ অথবা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম।

গ্রামে যাঁরা ছাগল পালন করেন, তাঁরা চেষ্টা করেন চেনা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ছাগী সংগ্রহ করতে। সেটাই এ দেশের চল। এখন চারদিকে দু-একটা খামার গড়ে উঠলেও সেগুলো মূলত খাসি তৈরি আর বিক্রির জন্য। ছাগী বিক্রয়ের জন্য খামার এ দেশে নেই বললেই চলে। ফলে একসাথে বিতরণযোগ্য ছাগল কেবল দালালের মাধ্যমে হাট-বাজার থেকেই সংগ্রহ করা হয়। নিতান্তই ভাগ্য সহায় না হলে গৃহস্থের বাড়ি থেকে বাদ পড়া এসব ছাগলে ভাগ্য ফেরে না গরিবের। বিতরণকৃত ছাগলের শতকরা ৬৭ ভাগ মারা যাওয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর এ দেশের এক বিশিষ্ট উন্নয়ন সংগঠন ওপথে আর না হাঁটার শপথ নেয়। কেউ কেউ হাট থেকে না কিনে গ্রামের ভেতর থেকেই সংগ্রহের কাজে এখন মন দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিষেধকের ঝামেলায় প্রতিবছর ছাগলের মড়ক লাগার ঘটনা এ দেশে নতুন নয়।

এ ছাড়া উত্তরের ছাগল দক্ষিণের লোনা জলে লোনা ঘাসে তিষ্ঠতে পারে না। দক্ষিণের বা পাহাড়ের ছাগল নদীর জলে ধোয়া উত্তরের জনপদে খাপ খাওয়াতে পারে না।

তারপরও সামনে যত বিপদেই মানুষ থাকুক না কেন, সে তার গবাদি প্রাণী ছাগলকে ছাড়তে চায় না। ইংল্যান্ডের পূর্ব লন্ডন যুগ যুগ ধরে শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল হয়ে আছে। সতেরো শতক থেকে এখানে এসেছে ফরাসি, আইরিশ, আশকেনাজি ইহুদি এবং সর্বশেষ বিশ শতকে বাংলাদেশিরা। বছর কয়েক আগে পূর্ব লন্ডনের সেই সব ঐতিহ্য স্মরণ করে একটা ভাস্কর্য তৈরির প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। শরণার্থীদের প্রতীক কত কিছুই না হতে পারত। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে পূর্ব লন্ডনের স্পিটাফিল্ডে এখন শোভা পাচ্ছে কেইন হান্টারের বানানো সাদা ছাগলের এক মূর্তি। অনেকগুলো মালামালের বাক্সের স্তূপে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছাগল।

নদীভাঙন বা বন্যায় উচ্ছেদ মানুষ যেমন নৌকায় মালামালের ওপর তার শেষ সম্বল ছাগলটাকে দাঁড় করিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই সেই অবাক মূর্তি। পূর্ব লন্ডনের অধিবাসী বা আদি শরণার্থীরা কেউ এসব নিয়ে মন খারাপ করেনি। বরং সবাই এটাকে ইতিহাসের অংশ আর বিবর্তনের প্রতীক হিসাবে মেনে নিয়েছে। গবাদি প্রাণীর সঙ্গে মানুষের তুলনা মানুষের মন খারাপ হয়, কিন্তু বন্য হিংস্র বাঘ-সিংহের সঙ্গে তুলনা দিলে সে পুলকিত হয়। মানুষ কি এখনো বন্য?

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষক।