ট্রাম্পই ভীতির কারণ

জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড
জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড

গত কয়েক দিনে যেসব ভয়ংকর ঘটনার কথা আমরা জানতে পারলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাপার হলো পারমাণবিক বোমার সুইচের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের আঙুল ঘুরে বেড়ানো। জানা গেল, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা অতীত ও বর্তমানে যত ক্ষমতা ভোগ করেছেন ও করছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে ভারসাম্যহীন ব্যাপার হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা। সভ্যতাবিধ্বংসী এই মহাক্ষমতা তিনি এককভাবে ব্যবহার করেন।

এই গত কয়েক মাসেই ট্রাম্প বুঝে গেছেন, ওভাল অফিসে বসলেই ডিক্রি দিয়ে সব পরিবর্তন করা যায় না। এর জন্য তাঁকে হাউস ও সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে, যেটা অত সহজ নয়। তিনি যদি অভিবাসন নীতি বদলাতে চান, তাহলে স্রেফ একটি আদেশই যথেষ্ট নয়। আদালত তাঁকে আটকে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি দূরবর্তী শত্রুর ওপর গুলি ও ক্রোধ বর্ষণ করতে চান এবং পরিণামে নিজের জনগণসহ অন্যদের জীবনে একই পরিণতি বয়ে আনেন, তাহলে তাঁকে থামানোর উপায় নেই। সে কারণে ভূরাজনৈতিক রচনায় ট্রাম্পকে ‘পারমাণবিক সম্রাট’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

তো কথা হলো, আপনি এই ব্যবস্থার সরলতার কথা যত বেশি শুনবেন, এটা ততই ভীতিকর হয়ে উঠবে। ট্রাম্প যদি সিদ্ধান্ত নেন, কিম জং উনের বকবকানি অনেক সহ্য করেছেন আর না, তাহলে তাঁকে স্রেফ যা করতে হবে তা হলো, তাঁর সঙ্গে যে নিম্ন পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা থাকেন, তাঁর কাছ থেকে কালো ব্রিফকেসটা নিতে হবে। এই ব্যাগটি পারমাণবিক ‘ফুটবল’ হিসেবে পরিচিত। ব্যাগের ভেতরে অপশনের একটি মেনু আছে, যার বিস্তারিত বিবরণ থাকে ‘ব্ল্যাক বুকে’। ট্রাম্পকে শুধু সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অর্থাৎ ফোনটা তুলে পেন্টাগনের ওয়ার রুমে ফোন করে কোড বলে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রমাণ করে নির্দেশ দিতে হবে। ব্যস, এটুকুই।

এর জন্য তাঁকে কারও সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে না। পররাষ্ট্র বা প্রতিরক্ষা—কোনো মন্ত্রীর সঙ্গেই তাঁর আলাপের প্রয়োজনীয়তা নেই। পেন্টাগনে যে কর্মকর্তারা আছেন, এই নির্দেশকে প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। তাঁদের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে নির্দেশ বাস্তবায়ন করা। প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দেওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করবে। কথা হচ্ছে, এত ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে থাকাটা সমীচীন নয়, এমনকি সেই ব্যক্তি যদি সুলতান সোলায়মানও হন। পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ বিষয়ক সাবেক কর্মকর্তা ব্রুস ব্লেয়ার বলেছিলেন, ট্রাম্পের হঠাৎ খেপে যাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত আত্মগর্ব, সমালোচনাকারীর প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা—এসব দেখে তাঁর প্রজ্ঞার ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না।

আবার ২০১৫ সালে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমার কাছে পরমাণু আরেকটি শক্তি, ধ্বংসযজ্ঞ আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ এমনকি নির্বাচনী প্রচারণার সময় পোডিয়াম থেকে তিনি বলে ওঠেন, ‘যুদ্ধ আমার পছন্দের ব্যাপার’। গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য জো স্কারবরো বলেছিলেন, পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞদের এক ব্রিফিংয়ে ট্রাম্প নাকি তিনবার বলেছিলেন, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে আমরা তা ব্যবহার করতে পারব না কেন?

হিলারি ক্লিনটন তো ১৪ মাস আগে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীই করেছিলেন যে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলবেন। এখন উত্তর কোরিয়ার হুমকির জবাবে তিনি যেভাবে সমর প্রস্তুতির কথা বলছেন, তাতে হিলারির কথাই সত্য প্রমাণিত হলো।

এখন কয়েকজন উদ্ধারকর্তার ওপর আমাদের আশা নির্ভর করছে। এটা হতে পারে যে সাবেক জেনারেল ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস, চিফ অব স্টাফ জন কেলি ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এইচ আর ম্যাকমাস্টার—এই ত্রয়ীর ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। তবে গভীর রাষ্ট্র-বিষয়ক আমাদের আকাশকুসুম কল্পনা সেই ছায়ার মানুষের প্রতীক্ষায় আছে, যাঁরা শুধু ট্রাম্পকে টেনে ধরবেন না, তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাবেন। এই গল্পের নির্ধারিত নায়ক হচ্ছেন সাবেক এফবিআই পরিচালক রবার্ট মুয়েলার, যিনি এখন রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের যোগসাজশ ও তাঁর বৃহত্তর ব্যবসা-বাণিজ্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন।

তাঁর ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবে নিশ্চিতভাবেই এই উল্লিখিত আকাশকুসুম কল্পনা ট্রাম্পের প্রতিপক্ষের এমন এক লক্ষ্য, যেখান থেকে আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। একটা ব্যাপার হচ্ছে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে উদারনীতিকেরা কামনা করছেন, অনির্বাচিত জেনারেলরা একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে প্রতিহত করবেন। এটা একসময় সামরিক বাহিনীর ডানপন্থীদের কল্পনা ছিল।

কিন্তু এটা এখন প্রমাণের চেয়ে আশার ওপরই বেশি নির্ভর করছে। ট্রাম্পের আশপাশে যে বিজ্ঞ লোকেরা আছেন, তাঁরা এত দিনে তাঁকে কতটা সংযমী করতে পেরেছেন? কেলির কাজ ছিল শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা ঠিক করা, আর ট্রাম্প এখনো এমন সব টুইট করে যাচ্ছেন, যা দেখে যুদ্ধের ইঙ্গিত মনে হয়। উপদেষ্টারা তাঁকে স্রেফ টেনে ধরার চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এককভাবে ট্রাম্পের। তিনি পারমাণবিক সম্রাট।

মন খারাপ করা সত্যটা হচ্ছে, ট্রাম্পের মতো এমন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ভীতিকে কার্যকরভাবে ভারসাম্যে আনতে পারে শুধু জনগণ। শেষমেশ, কংগ্রেস সদস্যদেরই এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, অর্থাৎ ট্রাম্পকে অভিশংসন করে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে তাঁদের। রিপাবলিকানরা যদি তা না করেন, তাহলে ভোটারদের কাজ হবে, এঁদের সরিয়ে ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচিত করা। ২০১৮ সালের নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তাঁরা এক কাজ করতে পারেন। সমস্যা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর এত সময় আছে কি না, তা পরিষ্কার নয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড: দ্য গার্ডিয়ানের কলামিস্ট।