রাজনৈতিকীকরণ বন্ধে এক্সপাঞ্জ কাম্য

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন
ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক দুই সভাপতি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব রায়ে অস্বীকার করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ দাবি করছে। কিন্তু রায়ে তা দেখা যায় না। তাহলে আন্দোলন কেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: এটা সরাসরি বলার দরকার পড়ে না। (তিনি ‘নো নেশন-নো কান্ট্রি ইজ মেড অব অর বাই ওয়ান পারসন’ অংশটি পড়ে শোনান)। কোনো জাতি বা দেশ কোনো এক ব্যক্তিকে দিয়ে গড়ে ওঠে না, কিংবা কোনো একজন দ্বারা তা গঠিতও হয় না।

প্রথম আলো: যা পড়লেন তাতে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা বা তাকে অস্বীকারের কথা নেই। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা আমরা জনগণ দিয়ে শুরু হয়েছে। আর এই রায় আমিত্ববাদের বিরুদ্ধে একটি জোরালো উচ্চারণ। এতে ভুল কোথায়? বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে হয়েছে। সে কথা রায়ে স্পষ্ট বলা আছে।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: সেভাবে কিন্তু বলা নেই। আর আমাদের আন্দোলন শুধু এই একটি বিষয়েই নয়। অন্যান্য পর্যবেক্ষণের বিষয়েও রয়েছে। মামলা হয়েছে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে। অর্থাৎ সংসদের কাছে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকবে কি থাকবে না। সেখানে এক ব্যক্তি বা একক নেতৃত্বে হয়নি, সেটা একটা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়।

প্রথম আলো: আপনি যে অংশটি ওপরে উল্লেখ করলেন, সেখানে বিষয়টি এভাবে নেই!

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: সেটা তো ব্যাখ্যার বিষয়।

প্রথম আলো: তার মানে আপনারা যে আন্দোলন করছেন, সেটা একটি ব্যাখ্যানির্ভর বিষয়, তথ্যনির্ভর নয়?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: তা তো বটেই। এখানে উনি যেভাবে লিখেছেন তাতে ওই সময়ে মানে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো নেতৃত্ব কি ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য? অন্য কোনো নেতৃত্ব তখন ছিল না।

প্রথম আলো: আপনি বলছেন, এই প্রেক্ষাপটে যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, সেটা আপনাদের একটি ধারণা?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: আমাদের ধারণা।

প্রথম আলো: আপনাদের ধারণা ওই বাক্য বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করেই বলা হয়েছে?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: এটাই আমাদের ধারণা। শুধু আমরা একা নই, অনেকেই এই ধারণা করছেন।

প্রথম আলো: প্রতিকার কীভাবে?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: এর প্রতিকার নয়, এই পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ করতে হবে।

প্রথম আলো: এটা কীভাবে হবে, রিভিউতে?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: রিভিউর প্রয়োজন নেই। তাহলে তার অর্থ হয়, আমি বিষয়টি নোটিশে নিলাম। মাননীয় বিচারপতিরা যাঁরা এটা লিখেছেন, তাঁরা যদি মনে করেন কিছু পর্যবেক্ষণ জনমনে অসন্তোষ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে, তাহলে তাঁরা স্বপ্রণোদিতভাবে এক্সপাঞ্জ করতে পারেন। রায়কে রাজনৈতিকীকরণের চেষ্টা করা হয়েছে।

রায় ঘোষণার পরপরই বিএনপি তো মিষ্টি খেয়েছে। তাদের মহাসচিব বলেছেন, এটা ঐতিহাসিক রায়। আবার একজন বলেছেন, সরকারের পদত্যাগ করা উচিত।

প্রথম আলো: জিয়াউর রহমানকে অবৈধ সেনাশাসক, নোংরা রাজনীতি এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন করার জন্যও তিরস্কার করা হয়েছে। সেটা কী বলবেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: আমি কোনো তুলনামূলক বিষয় বলতে চাই না। আমাদের ধারণা ও বিশ্বাস যেটা সেটা, এবং শুধু এটা নয়, সংসদ সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এ ছাড়া অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ যেখানে কোনো আলোচ্য বিষয় ছিল না, তা-ও আনা হয়েছে।

প্রথম আলো: ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে এর আগে আপিল বিভাগের চারটি পৃথক রায়ে বিরূপ পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এখন কেন অবাক হচ্ছেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: আরও ১০টি রায় থাকতে পারে। এটা এই মামলায় অপ্রাসঙ্গিক। আপনার সঙ্গে বিতর্কে যেতে চাই না। আমার কথা হলো, কিছু পর্যবেক্ষণ, যা দেওয়ার দরকার ছিল না, তা নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে। বিএনপির নেতারা সমগ্র রায়টি পলিটিক্যালাইজ করার চেষ্টা করছেন। সে কারণে বলছি, এই পর্যবেক্ষণগুলো আদালত কর্তৃক স্বপ্রণোদিতভাবে এক্সপাঞ্জ করা দরকার।

প্রথম আলো: আইনমন্ত্রী চারজন বিচারককে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ১১৬ অনুচ্ছেদের পর্যবেক্ষণ প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করায় ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের বাকিটা মেনেছেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: না, আমি তা বলব না। তার কারণ, এই রায়ে আরও পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার দরকার রয়েছে।

প্রথম আলো: আপনারা আদালতে যেতে চান না? প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: প্রধান বিচারপতি অনুধাবন করবেন যে এখানে একটা সমস্যা হয়েছে। এটা তিনি গুড ফেইথে করলেও বিরোধী দল বিষয়টিকে ক্যাপিটালাইজ করতে চাইছে।

প্রথম আলো: শুধু প্রধান বিচারপতি কেন? তাঁর যাবতীয় পর্যবেক্ষণের সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে সহমত পোষণ করেছেন আরও একজন বিচারপতি।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: যিনি টিম লিড করেছেন, তাঁর নামেই তো বিষয়টি আসবে।

প্রথম আলো: প্রত্যেক বিচারপতি রায় প্রদানে স্বাধীন।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: তাঁরা স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারেন। কিন্তু এটা প্রধান বিচারপতির নামেই আসবে।

প্রথম আলো: আপনাদের পরবর্তী কর্মসূচি কী? বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের লক্ষ্য কী?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: বুধবার মানববন্ধন করব। আমাদের দাবি কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ করা।

প্রথম আলো: রিভিউ?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: সেটা সরকারের বিষয়।

প্রথম আলো: আপত্তিকর অংশগুলো চিহ্নিত করে দেবেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: সেটা যদি আদালত থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা করতে পারি।

প্রথম আলো: এক্সপাঞ্জের বিষয়ে আদালতের কাছ থেকেই উদ্যোগ আশা করেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: না। আপনার কথার উত্তরে বললাম। আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে আমরা অনেকেই আছি। আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা তাঁরা করতেই পারেন। সে জন্য অনুরোধ করব না। সাবেক বিচারকেরা বলেছেন, আদালতই স্বউদ্যোগে বাদ দিতে পারেন।

প্রথম আলো: সাবেক দুজন আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আপনিও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রায়ের পরে সাক্ষাৎ করেছেন। কী আলোচনা হলো?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: প্রধান বিচারপতি আমাদের খবর দিয়েছিলেন। সেই বৈঠকে আমি এটা তুললাম যে রায়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় রয়েছে, এখন তাঁকে পলিটিক্যালাইজ করা হচ্ছে।

প্রথম আলো: বিএনপির প্রতিক্রিয়া আপনাদের তাড়া করল?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: তাঁরা অনেকে দেখিয়েছেন, প্রতিদিনই দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমরা চাইছি যে এসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয় থাকবে না।

প্রথম আলো: তাদের ব্যানারে দেখলাম, বিচারপতি খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করা হোক।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: সেটা তাদের অযৌক্তিক দাবি। কারণ, তিনি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি। তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো একটা ধৃষ্টতা। সব বিষয়ের একটি লিমিট থাকা উচিত, যা ক্রস করা উচিত নয়।

প্রথম আলো: কিন্তু কর্মরত প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধেও মন্ত্রীদের কেউ কেউ অশোভন মন্তব্য করেছেন।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: কে করেছেন তা জানি না। আমরা আমাদের আইনজীবী সমাজ, যাঁরা গত রোববারের সভায় বক্তৃতা করেছেন, তাঁরা মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেই যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে বক্তৃতা করেছেন। আমরা এটাও বলেছি, রায়ের প্রতি অবজ্ঞা নেই।

প্রথম আলো: একপাঞ্জযোগ্য আর কিছু নির্দিষ্ট করবেন?

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: সংসদ সদস্যদের অপরিপক্ব বলেছেন।

প্রথম আলো: না, বলা হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।