গণতন্ত্র কোনো খেলা নয়

সম্প্রতি বাংলাদেশে যে নির্বাচন হলো, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক বিস্তর হয়েছে, হয়তো আরও হবে। কিন্তু একটা বিষয় তো পরিষ্কার। নির্বাচনের ফলে শুধু গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রইল তা-ই নয়, কোনো তৃতীয় শক্তির উদ্ভবের সম্ভাবনাও অঙ্কুরে বিনষ্ট হলো। নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধীপক্ষের ‘জ্বালাও-পোড়াও ও মারো’ নীতির একটা বড় লক্ষ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটানো। যেন এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যাতে নাগরিক নিরাপত্তার খাতিরেই সেনাবাহিনীকে বাধ্য হয়ে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিতে হয়। তেমন ঘটনা যে ঘটেনি, আমার চোখে সেটি গণতন্ত্রের পক্ষে একটি বড় জয়। আমাদের সেনাবাহিনী যে এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক পেশাদারি এবং কঠিন রাজনৈতিক সময়েও নিজ দায়িত্বে নিষ্ঠাবান, সে কথারও প্রমাণ মিলল।
সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা উঠলেই আমাদের মাথায় আসে পাকিস্তানের কথা। রাজনীতিকেরা ব্যর্থ, ফলে তাঁদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য একান্ত বাধ্য হয়ে, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে নাক গলাতে হচ্ছে, এই ছিল তাঁদের যুক্তি। এই যুক্তির একটা লাগসই নামও দেওয়া হয়েছিল: ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনির যখন প্রথমবারের মতো এই তত্ত্বের প্রয়োগ করেন, তা ছিল রাষ্ট্রপ্রধান গোলাম মোহাম্মদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারকে একতরফাভাবে, প্রশাসনিক নির্দেশের মাধ্যমে বরখাস্ত করার যে সিদ্ধান্ত নেন, তা আইনসিদ্ধ করতে। যুক্তি ছিল, শাসনতন্ত্রের অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা। দেশ বাঁচলে তবেই না শাসনতন্ত্র রক্ষার প্রশ্ন ওঠে। দেশ-বিদেশের নানা উদাহরণ হাতিয়ে, এমনকি রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস ঘেঁটে বিচারপতি মুনির রায় দিয়েছিলেন, দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না। বিচারপতি হয়তো ভাবেননি, তাঁর এই অভিনব যুক্তি ব্যবহার করে সে দেশের সেনাবাহিনী যখন-তখন মখমলের গদিখানায় চড়াও হবে এবং দেশের মানুষের ওপর নিজের ইচ্ছামতো ছড়ি ঘোরাবে। ইসকান্দার মির্জা ও আইয়ুব খান থেকে হালের মোশাররফ পর্যন্ত—সবাই এই একই যুক্তি দেখিয়েছেন। বিচারপতি মুনির পরে নিজের আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের দুর্ভোগের শুরু ওই ১৯৫৪ সালের সিদ্ধান্ত থেকেই।
দোষ শুধু এক সেনাবাহিনীর নয়। এমন উদাহরণের অভাব নেই, যখন রাজনীতিকদের ব্যর্থতার ফলে দেশে শাসনতান্ত্রিক সংকট দেখা দিয়েছে, এমনকি গৃহযুদ্ধেরও সূচনা হয়েছে। দক্ষিণ সুদানে এখন যা ঘটে চলেছে, তা পুরোপুরি রাজনীতিকদের অদূরদর্শিতা ও নির্বোধ গোত্রভিত্তিক রাজনীতির ফল। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা সামাল দিতে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ‘কেউ না কেউ’-এর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসে সেনাবাহিনী। এর ফল যে সব সময় খুব ভালো হয়, তা নয়। উদাহরণ হিসেবে আজকের মিসরের কথা ভাবুন।
মিসরে বছর দেড়েক আগে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুডের দল সরকার গঠন করেছিল। সে দলের একতরফা কাজ-কারবারের ফলে সে দেশে ইসলামপন্থী ও সেক্যুলার গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। ফলে প্রায় গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়ে মিসর। এমন সময় ত্রাতা হয়ে উদয় হয় সেনাবাহিনী। সেক্যুলারপন্থীরা, যারা নির্বাচনে হেরেছিল এবং মুক্ত নির্বাচনে তাদের জেতার সম্ভাবনা নেই, এ কথা খুব ভালো করেই জানত, তারা ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে কান ধরে টেনে নামানোর জন্য ভর করল সেনাবাহিনীর ওপর। রাতারাতি সেনাবাহিনী হয়ে পড়ল গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা। যেসব ছাত্র, যুবক, শহুরে ভদ্রলোক বহুদলীয় গণতন্ত্রের দাবিতে হোসনি মোবারকের একনায়ক সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমতো ‘বিপ্লব’ করেছিল, তারা ভাবল, ব্যালটে না পারলেও বুলেটের ভয় দেখিয়ে ব্রাদারহুডকে ঠান্ডা করা যাবে।
আহাম্মক আর কাকে বলে!
১৯৫২ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিসরে প্রথমবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করে সে দেশের সেনাবাহিনী। সেই থেকে ২০১১ সালের ‘আরব বসন্ত’ বিপ্লবের আগ পর্যন্ত কার্যত সেনাবাহিনী ক্ষমতা আঁকড়ে থেকেছে। ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে গামাল আবদুন নাসের বা হোসনি মোবারকের নাম আমরা শুনেছি বটে, কিন্তু তাঁরা দুজনেই সেনাবাহিনীর ভেতরের লোক। সেনাবাহিনীর স্বার্থ রক্ষা করেই তাঁরা দেশ চালিয়েছেন। ২০১২ সালে মোবারককে হটিয়ে প্রথমবারের মতো একটি বেসামরিক সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। দুই বছর যেতে না যেতেই তাদের হটিয়ে আবার সেই সেনাবাহিনী। যারা আরব বসন্তের নামে একসময় রক্ত দিয়েছিল, সেই ছাত্র-যুবক-বুদ্ধিজীবী শ্রেণী নিজ হাতে গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব তুলে দিল সেনাবাহিনীর হাতে। এর চেয়ে অনেক কম আহাম্মকি হলো শিয়ালের হাতে মুরগি পাহারার দায়িত্ব দেওয়া।
৬০ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ফলে মিসরের সেনাবাহিনী যে কাজটি খুব উত্তমভাবে সমাধা করেছে তা হলো দেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। (বলাই বাহুল্য, পাকিস্তানেও সেই একই ঘটনা।) এক হিসাবে দেখছি, মিসরে অর্থনীতির ৪০ শতাংশই সে দেশের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। আলপিন থেকে পাঁচ টনি ট্রাক, টেলিভিশন থেকে রেফ্রিজারেটর—হেন জিনিস নেই, যা সামরিক বাহিনীর নিজের কারখানায় উৎপাদিত হয় না। স্কুল, কলেজ, স্টেডিয়াম এমনকি রেস্তোরাঁ পর্যন্ত তাদের মালিকানাধীন। যেকোনো বড় নির্মাণ প্রকল্পের তারা অংশীদার, সবার আগে যে দরপত্রটি আমলে আনা হয়, তা আসে সেনাবাহিনীর নামে। মাস খানেক আগে কায়রো-আলেকজান্দ্রিয়া মহাসড়কে টোল সংগ্রহের দায়িত্ব পেয়েছে সেনাবাহিনী। এত দিন বেসরকারি কোম্পানি যে কাজ করত, এখন সেই মহান দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে সে দেশের সেনানিয়ন্ত্রিত একটি কোম্পানি।
এসব দেখাশোনার পরও মিসরের মানুষ, প্রধানত শহুরে মধ্যবিত্ত ও সেক্যুলার যুব শ্রেণী, সেই সেনাবাহিনীর হাতেই দেশ চালানোর বইঠা তুলে দিয়েছে। সম্প্রতি মিসরের মানুষ একটি নতুন শাসনতন্ত্রের জন্য গণভোটে অংশ নেয়। বিপুল ভোটাধিক্যে তারা যে শাসনতন্ত্র অনুমোদন করে, তাতে সামরিক বাহিনীকে সরকার বা আইন পরিষদ এমনকি বিচার বিভাগের কোনো রকম খবরদারির বাইরে রাখা হয়েছে। দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কে হবেন, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন কোনো সম্পত্তির ওপর হামলা হলে তার বিচার হবে সেনাবাহিনীর নিজস্ব আইনে। এমনকি দেশের সামরিক বাজেটের ব্যাপারেও শেষ কথা বলার অধিকার তুলে রাখা হয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। হোসনি মোবারকের আমলেও সেনাবাহিনী এমন ‘যা ইচ্ছা তা-ই’ করার অধিকার ভোগ করেনি। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, গণভোটে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের ৯৮ শতাংশ এই শাসনতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে। শাসনতন্ত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে কারণে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকেরা এই গণভোটে অংশ নেয়নি। ধরে নেওয়া যায়, যারা এই নতুন শাসনতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে, তাদের অনেকেই দুই বছর আগে মোবারকের শাসনের বিরুদ্ধে বহুপক্ষীয় গণতন্ত্র দাবি করে মিছিল করেছে, পুলিশের গুলি বুক পেতে নিয়েছে। কয়েক শ মানুষ যে মারা গেল, তা কি গণতন্ত্রের নামে সেনাশাসনকে আইনসিদ্ধ করতে?
দৃশ্যত, গণসমর্থনেই মিসরে সেনাশাসন অনুমোদিত হলো। পাকিস্তানে যতবার বেসামরিক সরকারকে লাথি মেরে দূর করা হয়েছে, প্রতিবারই সে দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশেও সেই একই কাণ্ড প্রায় ঘটতে চলেছিল। আমরা অনেকেই ভয় পেয়েছিলাম, এবারও এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। জানমালের নিরাপত্তার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ চাই, এমন ফিসফিসানি শোনা গেছে। শেষ পর্যন্ত তা যে হয়নি, তার একটা কারণ গণতন্ত্রের পক্ষে নাগরিক সংহতি। মিসর বা পাকিস্তানের কথা জানি না, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ শাসনতন্ত্রবহির্ভূত কোনো সরকারকে কখনোই সমর্থন জানায়নি। চেষ্টা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আখেরে ফল ভালো হয়নি। যাঁরা ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ বেসামরিক আদালতে ফাঁসির সাজা পেয়েছেন, অন্যরা পলাতক। প্রায় এক দশক ধরে যে জেনারেল ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন, দেশের মানুষ তাঁকে জানে স্বৈরশাসক অথবা বিশ্ববেহায়া হিসেবে।
আমি এ কথা বলি না, বাংলাদেশে কখনোই সামরিক অভ্যুত্থান হবে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতি ব্যর্থ হলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তার ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ না কেউ ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করবেই। আমাদের শুধু হুঁশিয়ার থাকতে হবে, এমন কোনো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়। এই দায়িত্ব শুধু পেশাদার রাজনীতিকদের নয়, আমাদেরও। কারণ, গণতন্ত্র গ্যালারিতে বসে দেখার কোনো খেলা নয়।

নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।