যমুনার বুকে ৮ দুর্ভাগা জেলে

ভাদ্রের দুঃসহ গরম; বাতাস থেমে আছে। শুক্রবার সকাল ১০টায় সারিয়াকান্দি শহর রক্ষা বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ডানে, বামে ও সামনে তাকালে দেখা যায় শুধু পানি। যমুনা নদী তার উভয় পাশের চরাগুলো প্লাবিত করে বয়ে চলেছে।

বগুড়া জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা সারিয়াকান্দির বন্যাদুর্গত চরাঞ্চলের মানুষেরা কেমন আছে, তা দেখার জন্য কালিতলা গ্রোয়েনঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উত্তর দিকে রওনা দিলাম। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া বন্যার পানিতে এই নদীর উভয় পাশের সব চরা ফুলেফেঁপে আশপাশের জনপদগুলো প্লাবিত করেছিল। কোথাও কোথাও নদীর স্রোত এত তীব্র ছিল যে টিনের ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে; এমনকি বড় বড় গাছও শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলেছে। ঘরহারা মানুষেরা সহায়-সম্বল যার যেটুকু আছে, তা নিয়ে উঠেছিল উঁচু কোনো বাঁধে কিংবা সরকার আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছে, এমন বিদ্যালয়গুলোতে।

এখন বন্যা নেই। জলমগ্ন চরাগুলো এখন নিস্তরঙ্গ; কোথাও কোথাও পানির তলা থেকে জেগে উঠেছে মলিন ধইঞ্চাখেত কিংবা কলমির ঝোপ। দূরে দূরে, নিচু হয়ে থাকা কালো কালো গ্রামগুলোর কিনারে কোমরপানিতে নেমে জাগ দেওয়া পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন হাড্ডিসার কালো কালো দেহাতি মানুষ। উলঙ্গ শিশুরা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে।

প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পর এক জেলেনৌকার দেখা মিলল। তারা জালা তুলছিল, সেই কাজ অসমাপ্ত রেখে আমাদের দিকে তাকাল। চোখেমুখে কৌতূহল। তাঁরা মোট আটজন। আমরা তাঁদের সঙ্গে কথা শুরু করলাম।

যাঁকে সবচেয়ে বেশি বয়সী দেখাচ্ছিল, তাঁর নাম ওসমান গনি, বয়স ৬২। সবচেয়ে ছোটজন বাসুদেব নমদাস, ১৭ বছরের হালকা-পাতলা কিশোর। তাদের মতো নমদাস আরও তিনজন: সম্পদ নমদাস, খোকন নমদাস ও পিন্টু নমদাস। প্রত্যেকেরই বাপ-দাদা ও পরদাদারা যমুনা নদীতে মাছ ধরতেন।

এই আট জেলে সাতসকালে নৌকা আর জাল নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়েছেন। নৌকা চলছে শ্যালো মেশিন দিয়ে। ৪৫০ টাকার ডিজেল কেনা হয়েছে। নৌকা কিংবা শ্যালো মেশিন কোনোটারই মালিক তাঁরা নন। এক মহাজনের কাছ থেকে চেয়ে এনেছেন। শর্ত এই যে মাছ যতটুকু ধরা পড়বে, তা ভাগ করা হবে ১০ ভাগে। নৌকা ও শ্যালো মেশিনের মালিক পাবেন দুই ভাগ, বাকি আট ভাগ পাবেন এই আট জেলে।

বাসুদেব নমদাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সকালবেলা কী খেয়ে বেরিয়েছ?’

লাজুক মুখে বলল, ‘পান্তাভাত।’

‘কী দিয়ে? পান্তাভাতের সঙ্গে আর কী ছিল?’

মলিন হেসে বলল, ‘কী আর থাকপি? খালি নুন।’

‘দুপুরবেলা কিছু খাওয়া হবে?’

‘ওই পান্তাভাতই।’

‘খালি নুন দিয়েই?’

‘পেঁজ-মরিচের দাম বাড়ি গেছে। তাই খালি নুন দিয়েই পান্তা খাওয়া লাগে।’

‘আর রাতের খাবার?’

‘রাত্রিরে ভাত আন্দা হবি। সিদিনক্যা পনর ট্যাকা দিয়ে আদবা (আধা পোয়া, মানে ১২৫ গ্রাম) মসুর ডাল কিনিছিনু। তারই এত্তিকোনা আন্দা হবি।’

বাসুদেব নমদাসদের ছয় সদস্যের পরিবার রাতে মসুর ডাল দিয়ে কিছুটা ভাত খাবে। আর কিছু ভাতে পানি ঢেলে রাখা হবে, যেন তারা সকালবেলা নুন দিয়ে পান্তাভাত খেতে পারে। পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের দাম আকাশে ওঠার আগে তারা পান্তা খেতে নুনের সঙ্গে পেঁয়াজ-মরিচের স্বাদও পেত।

বাসুদেব, সম্পদ, পিন্টু ও খোকন—এই চার নমদাসের পরিবারের অবস্থা প্রায় একই রকম। তারা শুধু নুন-ভাত, আলুভর্তা আর একটুখানি মসুর ডাল খেয়ে বেঁচে আছে। তারা জেলে, মাছ ধরে বিক্রি করে, কিন্তু সেই মাছ তারা নিজেরা খেতে পায় না। কারণ, যেটুকু মাছ তারা পায়, তা যদি নিজেরাই খেয়ে ফেলে, তাহলে চাল-নুন কেনার পয়সা থাকবে না।

আট জেলের প্রত্যেকের ‘খাদ্য পরিস্থিতি’র সমীক্ষা পাঠকের কাছে একঘেয়ে মনে হতে পারে। ওসমান গনিরটা সংক্ষেপে এ রকম: তিনি সকালবেলা ভাত খেয়ে বেরিয়েছেন, ভাতের সঙ্গে একটু গুঁড়া মাছও ছিল। ওই মাছ তাঁর নিজের ধরা নয়, বাজার থেকে কিনেছিলেন। কিনতে পেরেছিলেন; কারণ, তাঁর কাছে যৎসামান্য টাকা আছে। তাঁর এক ছেলে ঢাকায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক, তিনি প্রতি মাসে হাজার-দুই হাজার টাকা পাঠাতে পারেন।

এর মধ্যে জাল তোলা হলো; যে পরিমাণ মাছ পাওয়া গেল, তা বড়ই অকিঞ্চিৎকর। আর মাছ বলতে মলা-ঢেলাজাতীয় খুবই ছোট ছোট মাছ, দুই-তিনটা ছোট বাইন, দুটো ছোট চিংড়ি। ওসমান গনিকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই মাছ বিক্রি করে কত টাকা পাওয়া যাবে? তিনি উত্তরে বললেন, দুই-তিন শ টাকার বেশি নয়।

এইভাবে আটজন মানুষ সারাটা দিন ধরে রোদে পুড়ে, পানিতে ভিজে আরও কতবার জাল ফেলা-তোলা করে দিন শেষে যে পরিমাণ মাছ পাবেন, বাজারে তা যদি ১ হাজার ২০০ টাকা হয়, তাহলে তাঁদের প্রত্যেকের ভাগে কত টাকা করে জুটবে? সেই টাকা দিয়ে তাঁরা কী কতটুকু কিনতে পারবেন?

‘হামরা জনপ্রতি আশি-নব্বই ট্যাকা করে পাবার পারি।’ বাসুদেব নমদাস আমাকে বলে।

তাঁরা একটা ভালো খবর দিলেন। সেটা হলো, নৌকা ও শ্যালো মেশিনের মালিক দয়ালু ব্যক্তি। যেদিন দুই হাজার টাকার কম মাছ ধরা পড়ে, সেদিন তিনি নিজের ভাগ নেন না। শুধু ডিজেল কেনার জন্য যে টাকাটা দেন, সেটুকু নেন।

এই জেলেদের এমন দুর্দশা চলছে প্রায় তিন মাস ধরে, অর্থাৎ নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার পর থেকে। তাঁদের জালটা অগভীর পানিতে মাছ ধরার উপযোগী। বড় মাছ থাকে নদীর গভীরে। সেসব মাছ তাঁদের জালে ধরা পড়ে না।

এই জেলেদের বাড়ি যমুনাতীরের চন্দনবাইশা গ্রামে। যমুনার অপ্রতিরোধ্য ভাঙনকবলিত এই প্রাচীন জনপদের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ। কিন্তু সে কাহিনি এই নিরক্ষর, প্রায় নির্বাক জেলেরা গুছিয়ে বলতে পারেন না। তাঁরা শুধু বলেন যে তাঁরা শেষ হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবছর তাঁদের গ্রামটা একটু একটু করে যমুনার গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।

আমি অবশেষে বন্যার প্রসঙ্গ তুললাম। দেখলাম, তাঁদের বলার বিশেষ কিছু নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, ত্রাণ সাহায্য পেয়েছেন কি না। সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, কেউ ত্রাণ পাননি। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা যেন খবরের কাগজে কিছু না লিখি।

আমি জানতে চাইলাম, কেন?

বাসুদেব নমদাস বলল, একজন বলেছে সে ত্রাণ পায়নি, খবরের কাগজে তার নাম ছাপা হয়েছে। তারপর স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা সেই লোককে খুঁজে বের করে কঠোরভাবে শাসিয়ে গেছেন।

‘কী বলে শাসিয়েছেন?’

উত্তরে বাসুদেব বলে, ‘সাহায্য পাসনি, না পালু, কবা গেছু ক্যান? মানে হলো, সাহায্য না পাইলেও চুপ করে থাকা লাগবে, কওয়া যাবে না।’

জেলেদের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা সরকারের কাছে কী চান?’ সবাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে, কেউ কিছু বলতে পারে না।

আবার বললাম, ‘সরকারের উদ্দেশে আপনাদের কিছু বলার নাই?’

ওসমান গনি মুখ খুললেন। বললেন, ‘হামাগের গাঁওডা নদীত যায় যায়। সরকার জানি ভাঙনডা বন্ধ করে। সরকারের লোকেরা বর্ষার সমে আসে বালুর বস্তা ফেলে, সব বস্তা পানিত ভাসি যায়। শুকনার দিন আসলেই তারা গায়েব হয়া যায়। কিন্তু মাটি ফালানের কামডা করা দরকার শুকনার টাইমে। আপনে এই কথাডা পেপারেত ভালো কর‍্যা লেখ্যা দিয়েন।’

‘আর কিছু চান না?’

‘হামরা গরিব মানুষ, দুক্কু-কষ্ট হামাকেরে বন্দু। হামরা আর কী চামো?’

মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।