রাজনীতি যেন রাজনীতিকদের হাতেই থাকে

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং উপমহাদেশের অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জি যা বলেছিলেন, তার বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ধরনের প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট বা সুবিধাভোগীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং ঘটছে, তাতে দেশের রাজনীতিতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের দুটি সামরিক সরকার গণতন্ত্রের আবরণে প্রবেশ করতে গিয়ে দুটি ধারার অবতারণা করেছিল। জেনারেল জিয়া দল গঠন করতে গিয়ে বিভিন্ন দলের দলছুট এবং বেসামরিক আমলা, সামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও শিক্ষাবিদদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছিলেন। সেই ধারাকেই আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জিয়ার স্লোগান ‘রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করব’ এবং ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ তখন থেকেই ক্ষমতার রাজনীতির প্রধান উপাদান হয়ে আছে।

প্রায় এক যুগের ওপরের এই শাসন এবং নতুন ধারার রাজনীতিতে কয়েকটি উপাদান দল ত্যাগ করে নতুন দলে যোগ অথবা দল গঠন, মনোনয়ন-বাণিজ্যের প্রচলন, সুবিধাভোগীদের দলে টানা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে, যা ১৯৯১ সালের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের পর তো কমেনি বরং আরও বেড়েছে। এর ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তবে তার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না। ১৯৯১ সালের পরেও জিয়া ও এরশাদের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেড়েছে। সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলাদের দলে দলে হঠাৎ করেই রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কারণে প্রশাসনযন্ত্র দারুণভাবে রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে।

প্রশাসনে দলীয়করণের প্রভাবের ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়াও প্রশ্নবোধক হয়; বিশেষ করে, যেসব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া আর সব নির্বাচন, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের পর দলীয় সরকারের অধীনে দুটি নির্বাচন ১৯৯৬ ও ২০১৪ কেমন হয়েছে, তা হয়তো বেশি করে বলার প্রয়োজন নেই। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর বিষয়ও প্রায় একই রকম, যদিও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সব সময়ই দলীয় সরকারের অধীনেই হয়ে থাকে। এসব নির্বাচন প্রভাবিত হয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা, বিশেষ করে যাঁরা নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি এবং নেপথ্যে জড়িত।

স্মরণ থাকে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই সময়ে প্রায় ছয় লাখ সরকারি এবং আধা সরকারি কর্মকর্তার প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁরা সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকেন শুধু নির্বাচনকালীন কাগজে-কলমে নির্বাচন কমিশনের অধীনে আসেন। আমাদের দেশের বর্তমান সুবিধাভোগ বা প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবর্তে আমলাদের বেশির ভাগই প্রভাবিত। মাঝেমধ্যে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য রাজনৈতিক বক্তব্যকেও ম্লান করে দেয়।
এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও রেহাই দেয়নি।

অতীতে দেখা গেছে, রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত উচ্চপর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক আমলারা চাকরিতে থাকাকালে ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং দলে যোগদানের পথ সুগম করে রাখতেন। সম্ভব হলে সরকারি কোষাগারে এবং উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যৎ এলাকার উন্নতির নামে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন দল, বিশেষ করে সরকারি দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁরা। এরই মাধ্যমে ওই সব প্রতিষ্ঠানে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। যে বিষয়টিই প্রণব মুখার্জি উল্লেখ করেছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের প্রবণতা কিছুটা হলেও ঠেকাতে ২০০৮ সালে সর্বদলের সম্মতিতে নির্বাচনী আইন আরপিও ১৯৭২ সংস্কারকল্পে অনুচ্ছেদ ১২(১) এ দুটি উপধারা সংযোজন করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল ১২(১)(জে)। এতে বলা হয়েছিল যে সংসদ সদস্য পদে কোনো দলের নমিনেশন পেতে হলে অন্তত তিন বছর ওই দলের সদস্য থাকতে হবে। এর উদ্দেশ্য ছিল, যাতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সুবিধাভোগীদের এক দল থেকে অন্য দলে যেতে না পারা, কথিত মনোনয়ন-বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরা এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হঠাৎ করে মনোনয়ন পাওয়ার রাস্তা বন্ধ করা। দ্বিতীয়টি ছিল অনুচ্ছেদ ১২(১)(এফ), যার মাধ্যমে সরকারি বা আধা সরকারি সংস্থা এবং সামরিক বাহিনীর চাকরি শেষের অথবা ইস্তফা দেওয়ার কারণে অবসর গ্রহণের তিন বছরের মধ্যে দল কর্তৃক মনোনয়ন না দেওয়ার বিধান এবং একই ধারার (জি)-তে বাধ্যতামূলক অবসর, অপসারণ, বরখাস্ত—এ ধরনের কর্মকর্তাদের বেলায় পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

ধারণা করা হয়েছিল, এ ধরনের বাধ্যবাধকতায় হয়তো রাজনীতিতে সরাসরি প্রবেশের জায়গায় কিছুটা বাধ্যবাধকতা থাকবে। এ ব্যাপারে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সব দলেরই সম্মতি ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো যে ২০১৩ সালে একটি সংশোধনীর মাধ্যমে ১২(১)(এফ) অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়। এর মানে এই যে যেকোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন পেতে কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে তিন বছর যুক্ত থাকার প্রয়োজন নেই। যেকোনো অরাজনৈতিক ব্যক্তি যেকোনো দলের সরাসরি মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য হবেন। অন্যদিকে ১২(১)(জি) এখনো বলবৎ রয়েছে, যা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সদ্য সমাপ্ত আলোচনায় সুশীল সমাজের এবং মিডিয়ার প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই ওই বিধিনিষেধের সময় তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়াতে সুপারিশ করেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ। অন্যদিকে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপরের তিন বছরের বাধ্যবাধকতা তুলে নিতে অথবা হ্রাস করতে সরকারি দলের এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, নির্বাচন কমিশনও বিভিন্ন সময়ে সম্ভাব্য নব্য প্রার্থীদের কাছ থেকে অব্যাহতভাবে চাপের মুখে রয়েছে এবং এ ধারার পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করছে বলে প্রকাশ। অবশ্য এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি।

এ ধরনের চিন্তাধারা বাস্তবায়িত হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ধরনের সুবিধাভোগী বা প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট ধারা রয়েছে, সেই অবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না। এমনিতেই আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বেসামরিক প্রশাসনে রয়েছে দলীয় রাজনীতির প্রভাব। আমাদের রাজনীতিতে রাজনৈতিক মেধার ঘাটতি, তার ওপর রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতির লাগাম অরাজনীতিবিদদের হাতে চলে গেলে কী হতে পারে, পাকিস্তানকে দিয়েই তার উদাহরণ দিয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জি।

আশা করি, রাজনীতির কুশীলবেরা বিষয়টি ভাববেন।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক  পিএইচডি গবেষক