মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সমীকরণ

তুরস্ক-ইরান সম্পর্কের কখনো কোনো সাধারণ চরিত্র ছিল না। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে কখনোই সোজাসাপটা মৈত্রী, সহযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। এর পরিবর্তে তাদের সম্পর্কে সব সময় এসব উপাদান একত্র দেখা গেছে। এমন হয়েছে যে সম্পর্কটি একদিকে বা অন্যদিকে হেলে পড়েছে। ফলে উভয় দেশের সম্পর্কের প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

তুরস্ক-ইরান সম্পর্ক এখন সহযোগিতার দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যদি তাদের মধ্যে জোট না-ও হয়। এখনো সে কথা বলার সময় আসেনি। সম্প্রতি আঙ্কারা ও তেহরানের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ বেড়েছে বলে মনে হয়। গত আগস্টে ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ হোসেন বাঘেরীর নেতৃত্বে একটি বড় সামরিক প্রতিনিধিদল আঙ্কারা পরিদর্শন করে। তারা শুধু সামরিক নেতাদের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেনি, পাশাপাশি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গেও তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এরদোয়ানও শিগগিরই তেহরান সফরে যাবেন।

দেশ দুটির মধ্যে এই সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের অনুভূত উদ্বেগ ও হুমকি একটি জায়গায় মিলে যাচ্ছে। এটাকে এর বেশি কিছু ভাবা ঠিক হবে না। কারণ, বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়াসহ নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে ভিন্নমত হয়েছে, যদি সেটা সাংঘর্ষিক না-ও হয়।

সম্প্রতি নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে অভিন্ন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে দুটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আরব বসন্ত–উত্তর মধ্যপ্রাচ্যে কী ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, তা নিয়ে তেহরান ও আঙ্কারার মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পরিষ্কার দেখা যায়। তুরস্ক বা ইরান—কেউই মনে করেনি যে এটি কাতারের সঙ্গে উপসাগর-আরব জোটের বিচ্ছিন্ন লড়াই।

ব্যাপারটা হলো সৌদি-আরব আমিরাত-মিসরীয় অক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রশাসনের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন ব্যবস্থা চালু করতে চাচ্ছে, যার প্রতি জর্ডানের মতো দেশেরও সায় আছে। যৌক্তিকভাবে এই জোটের প্রতিপক্ষ হচ্ছে রাজনৈতিক ইসলাম, সেটা আরেকটু বর্ধিত করলে তার মধ্যে তুরস্ক ও প্রকাশ্য-ঘোষিত শত্রু ইরানও চলে আসে। সে কারণে এই নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থা আরোপ করা হলে সেটা এই দুই আঞ্চলিক শক্তির জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।

এর আগে তুরস্ক ও ইরান উভয়েই সৌদি নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর কাতারের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। বস্তুত এই সংকটের শুরুর দিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ তুরস্ক সফরে যান, যেটা এক বিরল সফরই বটে। সফরে উপসাগরীয় অঞ্চলে কী ঘটছে, সেটা নিয়েই তিনি আলোচনা করেন।

দ্বিতীয়ত, আরব বসন্ত উত্তর মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং তার সঙ্গে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস-উত্তর যুগে করণীয় নির্ধারণের ব্যাপারটা যুগপৎ চলে এসেছে। আইএস যত ভূমি হারাবে, ততই তার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে বিবাদ শুরু হবে।

ইরান ও তুরস্কের কাছে দুটি ব্যাপার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের নীতির অস্বচ্ছতা ও কুর্দিদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ইরান উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে, যুক্তরাষ্ট্র আইএস-প্রথম নীতি থেকে ইরান-প্রথম নীতি গ্রহণ করে কি না। অন্যদিকে তুরস্ক বিরক্ত। কারণ, সে বুঝতে পারছে না, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার কুর্দিদের আর কত দিন সামলে রাখবে এবং এই অংশীদারির শেষ লক্ষ্য হচ্ছে সিরিয়া।

উভয় দেশই সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সামগ্রিক লক্ষ্য কী হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইরাকে কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সিরিয়ায় তাদের স্বায়ত্তশাসন পাওয়া—এসব ঘটলে তুরস্ক ও ইরানের কুর্দিদের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সে ব্যাপারে উভয় দেশই উদ্বিগ্ন। সিরিয়ায় ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টির (পিওয়াইডি) নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে সিরীয় কুর্দি গোষ্ঠীর উত্থানের কারণে তুরস্ককে সিরিয়া নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

আইএস যখন সিরিয়ায় কুর্দি-অধ্যুষিত কোবানে শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও পিওয়াইডির মধ্যে যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স (এসডিএফ) গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তা আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। এই সম্পর্কের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে পিওয়াইডির সামরিক শাখা পিপলস প্রটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি)।

তুরস্ক মনে করে, পিওয়াইডি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সহযোগী সংগঠন, যাকে তারা জাতীয় হুমকি মনে করে। এরা তো নিজেদের জমি বাড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে এবং সামরিক সরঞ্জামাদি জোগাড় করেছে, যেটা এই ঐক্যের কারণে সম্ভব হয়েছে। আঙ্কারা ধরে নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এসডিএফকে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে মূল সেনা হিসেবে ব্যবহার করছে। এমনকি কুর্দি প্রভাবিত এলাকার বাইরেও তারা সেটা করেছে, তাই তুরস্ক মনে করে, সিরিয়ার কুর্দিদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে তারা এটা করছে। এক অর্থে তুরস্কের কাছে এসব এলাকা আইএসমুক্ত হওয়া মানে সেগুলো এসডিএফ ও পিওয়াইডির অধীনে চলে যাওয়ার শামিল।

অন্যদিকে ইরানও কুর্দিদের রাজনৈতিক অভিলাষের ব্যাপারে চিন্তিত, বিশেষ করে ইরাকি কুর্দিদের। ইরাকি কুর্দিস্তানের স্বাধীনতা মানে ইরাকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়া, যে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির ওপর ইরানের প্রভূত প্রভাব রয়েছে। স্বাধীন ইরাকি-কুর্দিস্তান পশ্চিম, তুরস্ক, ইসরায়েল ও তর্কযোগ্যভাবে ইরানের চেয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকবে বলেই প্রত্যাশা করা যায়। কুর্দিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে ইরানের ভেতরেও অনেক সমস্যা হবে। ইরানের কুর্দি জনগণ ও দলগুলোর সঙ্গে ইরাকি কুর্দিদের সম্পর্ক তুর্কি কুর্দিদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ।

এই অভিন্ন উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থের ব্যাপারটা গড়ে উঠছে না। যদিও উভয় দেশই কুর্দি রাষ্ট্র নিয়ে উদ্বিগ্ন, তুরস্ক চায় পিকেকে-ওয়াইপিডির হুমকি কমাতে; তার কাছে ইরাকের কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (কেডিপি) রাজনৈতিক লক্ষ্য বরং অধিকতর সহনীয়, যেখানে ইরানের কাছে ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো।

যাহোক, অভিন্ন উদ্বেগের কারণে এই দেশ দুটির মধ্যকার সমঝোতা হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা কোন পর্যায়ে কাজ করতে পারে, সেই সম্ভাবনা এখনো নানা শর্তের নিগড়ে বন্দী, আর আঞ্চলিক স্বার্থের ক্ষেত্রে ভিন্নতা তো তাদের মধ্যে বাদ সাধছে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

গালিপ দালায়: আল-জাজিরা সেন্টার ফর স্টাডিজের ফেলো।