'চাউল কিনতেই সোগ শ্যাষ'

গত কয়েক দিনে কেজিপ্রতি চালের ধরনভেদে মূল্য প্রায় ১০ টাকা বেড়েছে। ৪০ টাকার নিচে এখন আর কোনো চাল নেই। সরকারিভাবে দেওয়া ১০ টাকা কেজির চাল বন্ধ। নেই ওএমএস পদ্ধতির কম মূল্যের চালও। সারা দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। রংপুরের নিম্নবিত্ত-বিত্তহীন ও বানভাসি মানুষের জন্য তা আরও বেশি। আশ্বিন-কার্তিক মাস হওয়ায় কৃষিনির্ভর শ্রমিকদের কৃষিকাজও নেই। এ অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ দিশেহারা। তারা আতঙ্কিত চালের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।

রংপুরের মডার্ন মোড় বাজারে গত বৃহস্পতিবার আবদুল বাতেন নামের এক রাজমিস্ত্রি সেই আতঙ্কের কথাই শোনাচ্ছিলেন, ‘দিন হাইজরা তিন শ টাকা পাই। দুপুরে খাওয়ার পর আড়াই শ টাকা টেকে। প্রতিদিন দুই কেজি চাউল কিনতে এক শ টাকা যায়। বাকি টাকা দিয়া আর কিছু হয় না। শুনচি চাউলের দাম নাকি ৮০ টাকা কেজি হইবে। চাউলের দাম ৮০ টাকা হইলে মানুষ মিছিল করবে। তখন চাউলের দাম কমবে।’ সারা বছর ঘাঘট নদে মাছ ধরে সংসার চালান রংপুরের শেখ পাড়ার ইয়াসিন আলী। তিনি জানান, ‘কোনোমতে মাছ বেচে সংসার চলছিল বাবা, চাউলের দাম বাড়ি যায়া আর চলে না। চাউল কিনতেই সোগ শ্যাষ।’ রংপুরের চকবাজারের মুদিদোকানদার রাশেদুজ্জামান রাশেদ। তিনি বলেন, ‘চাউলের আড়তে গিয়ে এক দোকানে চাল দেখে অন্য দোকান থেকে ফিরে আসতেই আড়তদার বলছেন, আগের চাল বিক্রি হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও অনেকেই এসে চাল কিনে নিয়ে গিয়ে মজুত করছে।’

যেসব দিনমজুর মাসের ৩০ দিন কাজ পান না, তাঁদের অবস্থা ভয়াবহ। রংপুর বিভাগের অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষ বিভিন্ন এনজিওতে ঋণগ্রস্ত। না খেয়ে থাকলেও তাঁদের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতেই হয়। রংপুরের পায়রাবন্দে বাড়ি রিকশাচালক মতিয়ার ওরফে কালা মিয়ার। গরমে রিকশা চালাতে পারেন না বলে তিনি দিনে ঘুমান, সারা রাত রিকশা চালান। আশ্বিন-কার্তিক মাসে কৃষিকাজ থাকে না বলে রিকশাচালক বেশি থাকেন। কোনো কোনো দিন দুই শ টাকারও কম আয় হয়। তিনি বলেন, ‘ছাওয়াগুলা তো নাশতা পায় না। শুধু ভাত খায়। চাউলের দাম বাড়াতে খুব অসুবিধা হইচে।’

বাংলাদেশ যখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে, তখনো রংপুর নিম্ন আয়ের বিভাগই ছিল। গত মাসের বন্যায় যে অর্ধকোটির ওপর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার অধিকাংশই এই অঞ্চলের। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের। চালের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পারছেন না এই অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। এসব মানুষের চোখেমুখে একধরনের ভীতি কাজ করছে, চালের দাম আরও বেড়ে গেলে কী হবে, এই ভেবে।

১৫ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলো সূত্রে জানা গেছে, খোলাবাজারে ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে বিভাগীয় শহরে ১৫ টাকা কেজি দরে এবং ২০ সেপ্টেম্বর থেকে সারা দেশে দরিদ্রবান্ধব ১০ টাকা কেজির চাল আবার দেবে সরকার। খোলাবাজারে চাল প্রথমেই শুরু করা উচিত ছিল বন্যাদুর্গত এলাকায়। এ ব্যবস্থা হলে অনেকের উপকার হবে। ১০ টাকার চাল যেন গতবারের মতো অসাধু মানুষের হাতে না যায়। গত বছর নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার নাউতারা বাজারে মাইকিং শুনেছিলাম, যেসব ব্যক্তি অন্যায়ভাবে ১০ টাকার চালের কার্ড নিয়েছেন, তাঁরা কার্ড ফেরত না দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর দুদিন পর পত্রিকায় দেখেছি, হাজার হাজার অসাধু কার্ড ফেরত দিয়েছেন। এ বছর বন্যার্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণেও চাল কম দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে যেন এ রকম না হয়, সে বিষয়ে সরকারের আরও বেশি সতর্ক হওয়া জরুরি।

নিম্ন আয়ের মানুষ ত্রাণ পান, দিনমজুরি খাটেন, প্রয়োজনে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে দিনাতিপাত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থা দুর্বিষহ। অনেকেই শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল, অনেকেই হয়তো সামান্য চাকরি করেন। এ রকম স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট সীমাহীন। সব সময়ই এ শ্রেণির মানুষের কষ্ট বেশি। চাপা থাকে বলে তাঁদের পাশে কেউ দাঁড়ায় না। নিম্নমধ্যবিত্তদের মনের মধ্যে সব কষ্ট চাপা দিয়ে মুখে ভালো থাকার অভিনয় করতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। ওএমএস কিংবা ১০ টাকার চালে তাঁদের কোনো উপকার হবে না। তাঁদের জন্য চালের মূল্য কমানোই সমাধান। আসাদ আহমেদ নামের একজন দিনমজুর বলছিলেন, ‘যারা মধ্যম, তার কষ্ট খুব। হামরা সোগ কাজ কইরবার পারি। কিন্তু মধ্যমরা পারে না।’ নিম্নমধ্যবিত্তের সংকটও সরকারের আমলে নেওয়া প্রয়োজন।

বন্যাদুর্গত এলাকার ভয়াবহতা নিশ্চয়ই আরও বেশি। বন্যার পানি নেমে গেলে ত্রাণ দেওয়াও বন্ধ হয়। বন্যার পানি নামলেও তাদের কষ্ট থাকে দীর্ঘদিন। যাদের ঘর ভেসে গেছে, যাদের বাড়িঘর-মাটি বিলীন হয়েছে নদীতে, তারা কি তিন বেলা খেতে পাচ্ছে? নতুন ধান উঠতে আরও মাসখানেক লাগবে। তত দিন যদি চালের দাম এই গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে এখন যাদের চাল কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা অনুমান করাও কঠিন।

গরিব মানুষের ভালো থাকা না–থাকার একটাই মাপকাঠি, তারা তিন বেলা পেট ভরে খেতে পারে কি না। শিক্ষা-স্বাস্থ্যগত সুবিধা এখনো তাদের ভালো থাকার কোনো মানদণ্ড হয়ে ওঠেনি। এ বছরের তুলনায় গত বছর বন্যা হয়েছে অনেক কম। গত বছর সরকারি মজুত থেকে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ চাল বিতরণ করা হয়েছে, এ বছর তার চেয়ে কম বিতরণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ বছর বন্যার পূর্বাভাস জানা থাকলেও সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না। হাওর অঞ্চলে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পর সরকার যখন জেনেছে বড় বন্যা হবে, তখন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা জরুরি ছিল। যাতে বার্তার বিশেষ সহযোগিতা লাভ করে সেটা নিশ্চিত করা যায়।

সরকার যদি চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সরকারের সব অর্জন ম্লান হবে। গণমাধ্যম ও আড়তদারদের কারণে চালের দাম বেড়েছে বলে মন্ত্রীদের যে অভিযোগ, সাধারণ মানুষ তা বিবেচনা করবে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে।

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।