'তথাকথিত বিরোধী দল' ও বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি

একজন আর্জেন্টাইন বিচারকের কথা মেনে আজকের সংসদ অধিবেশন সামনে রেখে এই লেখা। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে বিচারক কী করবেন? দুটো বিকল্প—ইস্তফা দিয়ে বাড়ি চলে যাবেন, না-হয় স্বপদে বহাল থেকে আইনের শাসনের ঝান্ডা যদ্দুর সম্ভব আগলানোর চেষ্টা চালাবেন। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পরে আমার কাছে দ্বিতীয় বিকল্পই ভরসা।
বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র চলতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে চলে। এবং তা এবারই প্রথম নয়। ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন না। সেই প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অবৈধ উপায়ে মন্ত্রিত্ব লাভ ঠেকাতেই বঙ্গবন্ধু ৭০ অনুচ্ছেদ এনেছিলেন। এবারে তার শ্রাদ্ধ ঘটল। সরকারের ‘বিরোধিতাকারী’ দল মন্ত্রিত্ব করে গাছেরটা খাবে। মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিরোধী দলে থেকে তলারটাও কুড়াবে। সত্যি, এর কোনো তুলনা নেই। অভাবনীয়, অভূতপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব। এবারে আইনের একটা ফাঁক বলব। রওশন এরশাদের ‘সরকার বিরোধিতা’ ও তাঁর দলের মন্ত্রীদের যৌথ জবাবদিহির আইনগত বৈধতা স্বতন্ত্র সদস্যদের গ্রুপটি তুলতে পারবে। যদি কখনো পরিবেশ আসে, তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তাঁরা এটি ব্যবহার করতে পারেন। এই গ্রুপটিতে সুযোগসন্ধানী আছেন। আবার কিছু ভূমিকা রাখার হিম্মতওয়ালাও আছেন।
স্পিকার যখন বিরোধী দলের নেতার প্রজ্ঞাপন দেন, তখনো জাপা মন্ত্রিত্ব নেয়নি। তাই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন। বিরোধী দলের নেতা প্রসঙ্গ ছাড়া কোথাও রওশনের ‘দল’ এবং হাজি সেলিমের ‘গ্রুপ’ শব্দ দুটিতে পার্থক্য দেখা যাবে না। কেবল বিরোধীদলীয় নেতার সংজ্ঞা দিয়েছে কার্যপ্রণালি বিধি। এটি বলেছে, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল বা গ্রুপের নেতা।’
কে বিরোধী দলের নেতা হবেন, তা নিয়ে ১৯৭৩ সালের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন পেয়েছিল। সংসদীয় দল ও গ্রুপ সম্পর্কে প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনকালেই বিতর্ক ওঠে। সরকারদলীয় একজন সদস্য সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী সদস্যদের ‘তথাকথিত বিরোধী দল’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। সরকারের বিরোধিতাকারী গ্রুপের এক সদস্য আপত্তি তোলেন। বৈধতার প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বিরোধী দল’। দুর্বল যুক্তি ছিল তাঁদের। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতির ওপর তাঁরা জোর দেননি। যুক্তি দিয়েছেন, ‘বিরোধী দলের নেতাকে একটি কক্ষ দেওয়া হয়েছে। মাননীয় স্পিকার যখন এভাবে আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন, তখন সংসদে বিরোধী দল আছে কি না, এ সম্পর্কে রুলিং চাই। তিনি ১৯৬৫ সালের দ্য লিডার অব দি অপজিশন (প্রিভিলেজেস) অ্যাক্ট উল্লেখ করে বলেছিলেন, বিরোধী দলের নেতা হওয়ার জন্য কয়জন সদস্য বিরোধী দলে থাকতে হবে, ওই আইনে তা বলা নেই। বৈধতার এই প্রশ্ন নিয়ে সংসদে প্রায় ২০ মিনিট ধরে বিতর্ক হয়।
সরকারের বিরোধিতাকারী কয়েকটি দলের সংসদ সদস্য ও কয়েকজন নির্দলীয় সংসদ সদস্য সংসদকক্ষে আলাদা বসার ব্যবস্থা করার জন্য স্পিকারের কাছে অনধিক সাতজন একটি আবেদন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই বিতর্কে জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, জাসদের আবদুস সাত্তার এবং চারজন নির্দলীয় সদস্য অংশ নেন। নির্দলীয়রা ছিলেন—সৈয়দ কামরুল, মুহাম্মদ আবদুল্লাহ সরকার, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং চাই থোয়াই রোয়াজা।
ওই আবেদনে স্বাক্ষরকারীরা স্পিকারকে জানিয়েছিলেন, আতাউর রহমান খান তাঁদের নেতা। সেদিন যদি সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো, তাহলে খান হতেন দেশের ইতিহাসের প্রথম বিরোধী দলের নেতা। সেটা কেন হয়নি, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কারণ, সংসদ নেতা সেটা চাননি। বিরোধী দলকে সংখ্যার নিক্তিতে মাপা হয়েছিল। এখনো সেই ধারা চলমান।
আতাউর রহমান খান মত দিয়েছিলেন, সংখ্যা দেখবেন না। সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী দল বা গ্রুপ নেতাকে স্পিকার বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন। তাঁর মতে, ‘স্পিকারের স্বীকৃতির জন্য দল বা গ্রুপ ন্যূনতম কতজন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে, কার্যপ্রণালি বিধিতে তার কোনো উল্লেখ নেই।’ এই আইনগত অবস্থান আজও একই রয়ে গেছে। আতাউরের যুক্তি আজ বেশি বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন দলটি সংখ্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হলেও তারা ‘সরকারের বিরোধিতাকারী’ সংজ্ঞায় পড়ে না। পদে পদে বিধিবিধান লঙ্ঘিত হবে। তাই আতাউরের যুক্তি আজও বিবেচনাযোগ্য যে, ‘যেকোনো সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত দল বা গ্রুপের নেতাকে স্পিকার বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন।’ ১৬ সদস্য নিয়ে স্বতন্ত্রদের গ্রুপটি বৃহত্তম।
তিয়াত্তরে ওই বিতর্কের সমাপনী বক্তৃতায় সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে যুক্তি দিয়েছিলেন, তা তখন খুব সঠিক ছিল না এবং আজকের প্রেক্ষাপটে তো সঠিক বলে মানার সুযোগ আরও সীমিত। সংসদ নেতা বলেছিলেন, ‘আতাউর রহমান খান একা এক দলের একজন, আরেকদলের একজন, আর কয়েকজন নির্দলীয় সদস্য মোট পাঁচ-সাতজন সদস্য সংসদ ভবনে একটি কক্ষে একটি জায়গায় বসতে চেয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর সংখ্যাতত্ত্বের কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না, এখনো নেই। সংসদ নেতা হিসেবে তাঁর যুক্তি ছিল, ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো দলকে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। তবে ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে কোনো দল গঠিত হলে এবং ওই দলে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য থাকলে ওই দলকে পার্লামেন্টারি গ্রুপ বলা যেতে পারে। কিন্তু সংসদীয় দল বলা যাবে না। (সংসদ বিতর্ক, ১২ এপ্রিল ১৯৭৩, পৃষ্ঠা: ৯৬-৯৭)।
কতজন সাংসদকে নিয়ে বিরোধী দল হতে পারে, তা অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ওই অভিমতই এ বিষয়ে একমাত্র দিকনির্দেশনা। তবে সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান টানা চারটি সংসদে বিরোধী দল না থাকার পরে ১৯৮৪ সালে মত বদলান। এখন সংবিধানমতে বিরোধী সাংসদ থাকতেই হবে। কেউ না জিতলেও বেশি ভোটে পরাজিত অনধিক নয় প্রার্থী সংসদে সমমর্যাদায় বসবেন। এঁদের বলা হয় নন-কনস্টিটিউয়েন্সি মেম্বার অব পার্লামেন্ট বা এনসিএমপি।
সংসদ বিশেষজ্ঞ খোন্দকার আবদুল হক বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ওই দিকনির্দেশনা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণিত এবং ভারতসহ এই উপমহাদেশের সংসদীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’ তাঁর মতে, ‘খান নিজেও সংসদীয় কনভেনশন সম্পর্কে সংসদ নেতার সঙ্গে দ্বিমত করেননি। খানের যুক্তি ছিল, প্রধানমন্ত্রীর বর্ণিত কনভেনশন আইন দ্বারা অগ্রাহ্য করা সম্ভব।’ সেই আইন হয়নি। আর ওই কনভেনশন মানলেও ২০১৪ সালের রওশনের দলের মন্ত্রিত্ব ও তাঁর ‘স্বামীর দোয়ায়’ বিরোধী দলের নেতা হওয়া সংবিধান ও কনভেনশন দুটোরই পরিপন্থী। তাই আজ থেকে সংসদে যত ভোটাভুটি হবে, তার গোটা প্রক্রিয়ার আইনগত বৈধতার প্রশ্ন খড়্গের মতো ঝুলতে থাকবে।
খোন্দকার আবদুল হকের মতে, ৩১৫ সদস্যবিশিষ্ট প্রথম সংসদে আওয়ামী লীগ ৩০৭টি আসন লাভ করেছিল বলে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে কোনো সদস্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এর সঙ্গে আমি দ্বিমত করি; বরং বলব, এটা করে গোড়াতেই বিরোধী দলের প্রতি আওয়ামী লীগের ভ্রান্ত ধারণার বীজ রোপিত হয়েছে।
২০১৪ সালের আইনগত প্রশ্ন আর ১৯৭৩ সালের আইনগত প্রশ্নের মতো আরও অনেক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেটা হলো, কার্যপ্রণালি বিধি প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে একটি সংসদ চলতে পারে না। কারণ, জাতীয় পার্টি থেকে যারা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন, তাঁদের দলনেতা প্রধানমন্ত্রী এবং একই সঙ্গে তাঁদের দলনেতা রওশন এরশাদ। এটা আইনসংগত বা সংবিধানসম্মত নয়। সুতরাং হাজি সেলিমের গ্রুপের যে কেউ রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা কি না, সেই প্রশ্ন তুলতে পারেন। সত্যিকারের ‘সরকারবিরোধী’ হিসেবে যদি অনধিক ১০ জনও দাবি করতে পারেন, তাহলে স্পিকার তাঁদের গ্রুপের নেতাকেই বিরোধী দলের নেতা করবেন।
কোনো সংসদীয় দল বা গ্রুপের নেতা নির্ধারণে স্পিকারের কোনো ক্ষমতা নেই। স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সপ্তম সংসদে বলেছিলেন, ‘সরকারি দল এবং প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত অন্য কোনো সংসদীয় দল বা গ্রুপের নেতা-সম্পর্কিত কোনো বিধান নেই। সুতরাং এসব দল বা গ্রুপের নেতা নির্বাচনের বিষয়টি তাঁদের নিজস্ব ব্যাপার। এখন পর্যন্ত সংসদে অন্য কোনো দল বা গ্রুপের নেতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বা অনুরূপ স্বীকৃতিদানের কোনো সুযোগ রয়েছে বলে দেখা যায় না।’ (সংসদ বিতর্ক, ৬ জুন ২০০১)।
সংবিধানে বর্ণিত একটি বিশেষ অবস্থায় স্পিকারের ওপর ‘সংসদীয় দলের নেতৃত্ব’ নির্ধারণের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু কতজনকে নিয়ে এই দল হবে, সংবিধান সে বিষয়ে নীরব।
নির্বাচনের পরে প্রত্যেক সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন সম্পর্কে স্পিকারকে যথাযথভাবে অবহিতকরণের একটি বিধান থাকা দরকার। এটা না থাকার সুযোগ স্পিকার নিয়েছেন। এরশাদকে শপথ পড়িয়েই তিনি বিরোধী দলের নেতার প্রজ্ঞাপনটি জারি করেন।
চেতনাগতভাবে হাজি সেলিমের গ্রুপকেই প্রকৃত বিরোধী দল মনে হতে পারে। এদের মতো সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার মতো উক্তিও সাবেক ফার্স্ট লেডির পার্টি করছে না। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, রওশন ও হাজি সেলিম সংসদে কখন কে কার হবেন? তাঁরা আমাদের আইনপ্রণেতা। আইনকানুন ভাঙচুর করতে করতে তাঁরা এগিয়ে যাবেন। তা সত্ত্বেও খুশি হব, যদি ১৯৭৩ সালের সংসদ নেতার সিদ্ধান্তটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]