চাই আত্মসম্মানবোধের জাগরণ

মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যে জাতি হিসেবে আমাদের দাঁড়াতে সহায়ক হবে না, তা বলাই বাহুল্য। কোরিয়ান শিক্ষাবিদদের মতে, কোরিয়ার জাগরণের পেছনে ১৯০৫ সালের জাপানি আগ্রাসন, অপমান, নিগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের আত্মসম্মানবোধের পুনর্জাগরণ ঘটে। আমাদের আর এই পুনর্জাগরণ ঘটল না। আমরা যে গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসছি, তা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে না। যদিও আমাদের পোশাকশিল্পের কর্মীরা এবং মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত অদক্ষ শ্রমিকেরা বিদেশি বোদ্ধাদের তাক লাগিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। অবরোধ, সহিংসতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশের পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে হাজার হাজার ট্রাকে করে প্রায় ৩২ কোটি পাঠ্যপুস্তক বছরের শুরুতেই পৌঁছে দিয়েছে। তবে উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি আর আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত ঘটনার বিপরীতচিত্রই বেশি।
১. ভারতীয়রা গবেষণা করতে পারে না, এই অপবাদে ইংরেজ আমলে ভারতীয় অধ্যাপকদের জন্য গবেষণার তেমন সুযোগ ছিল না। একই পদে ইংরেজদের তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশের বিজ্ঞানীদের কাজ করতে হতো। জগদীশচন্দ্র বসুর শ্রেয়তর গবেষণাদক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই ইংরেজদের ভুল প্রমাণ করেছিলেন। যেকোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে আমাদের ঐক্যের কোনো অভাব নেই। সরকারি দল আর বিরোধী দলের মধ্যে যত অনৈক্যই থাকুক না কেন, জনপ্রতিনিধিদের নানা সুযোগ-সুবিধা লাভে ঐক্য অক্ষুণ্ন আছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট যখন বাসে দাঁড়িয়ে যান, তখন শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়। উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট যখন রাজপ্রাসাদ আর রাজকীয় যানবাহনের সুবিধা ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করেন, বেতনের ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় করেন, তখন একই প্রজাতির প্রাণী হিসেবে গর্ববোধ করি। এ ধরনের উদাহরণ দেশের নেতাদের ক্ষেত্রে ঘটলে নিশ্চয়ই গর্বে বুক ফুলে উঠত।
২. গণিত উৎসব করতে নারায়ণগঞ্জ গেলাম। ভোরে যানজটবিহীন উড়ালপথে মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। উড়ালপথ নেমে যখন তীব্র যানজটের মুখে ফেলল, তখন বুঝতে পারলাম এই উড়ালপথে শহরের শুধু সৌন্দর্যবর্ধনই হয়েছে, যাতায়াতের সুবিধা হয়নি। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে অধিকতর যানজট উপভোগ আর কোনো দেশের নাগরিকেরা করবে না। অবাক লাগে এমন মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্বের দেশে রেলপথের উন্নয়ন নেই, যদিও পার্শ্ববর্তী দেশে রেলপথ জনসাধারণের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
৩. ফুটবল একসময় ক্রিকেট থেকে অধিক জনপ্রিয় হলেও, এখন তেমনটি নেই। যদিও বিশ্বকাপ ফুটবল আসরের সময় পতাকা দেখে আমাদের দেশের নাম বোঝার কোনো উপায় নেই। শুধু তা-ই নয়, আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল হারলে আমাদের দেশে মানুষ আত্মহত্যা করে বা তাদের হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলে ফুটবলে ক্রিকেটের মতো অর্থের ততটা সমাগম না থাকলেও তার জনপ্রিয়তা রয়েছে।
সম্প্রতি টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে কুলীন দেশগুলোর প্রস্তাবে বাংলাদেশে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নিরাপদ-নির্বিঘ্নে ক্রিকেট খেলা আয়োজন নিশ্চিত করতে এমনকি অবরোধের কঠিন দিনগুলোতেও উভয় দলের সমর্থন ছিল। আমাদের দর্শকেরা প্রমাণ করেছেন, তাঁরা সত্যিকার ক্রিকেটপ্রেমী।
৪. সম্প্রতি শহরগুলোর যে সূচক প্রকাশিত হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের স্বপ্নের তিলোত্তমা ঢাকার স্থান সর্বনিম্নে। এই বিষয়গুলো কি আমাদের আত্মসম্মানবোধে বিন্দুমাত্র ধাক্কা দিতে পারছে? এমনকি সন্ত্রাসে বিপন্ন শহরগুলোর অবস্থানও আমাদের ওপরে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির মধ্যেও আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, সিআইএ কিংবা জাতিসংঘের হিসাবে মাথাপিছু আয়ে আমরা এখনো তাদের পেছনে। জাপানি জবরদখল কোরিয়াকে জাগিয়েছিল, কী মাত্রার অপমান আমাদের জাগাবে?
৫. সম্প্রতি ভারতের একজন কূটনীতিকের সম্ভাব্য নিয়ম লঙ্ঘনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁকে বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় ভারত থেকে সমমর্যাদার একজন কূটনীতিককে বহিষ্কার হলো আত্মসম্মানবোধের যোগ্য বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো পদ্মা সেতু নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাল, তার ক্ষুদ্রাংশও কি তারা ভারতের সঙ্গে করতে সাহস পেত? আমরা কি আমাদের আত্মসম্মানবোধকে ধরে রাখতে পেরেছি? একইভাবে কাঁটাতারের বেড়া কিংবা সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যার বিপরীতে আমাদের প্রতিক্রিয়ায় কি আত্মসম্মানবোধ ফুটে উঠেছে?
৬. একসময় ভারত অনেক সামগ্রীই উৎপাদন করতে পারত না। তাই বলে আমদানির দরজা খুলে দেয়নি। যে ভারত ভালো ব্লেড তৈরি করতে পারত না, যোগ্য নীতির ফলে এখন চাঁদে তারা রকেট পাঠায়, মঙ্গল গ্রহেও যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই ‘স্বদেশি পণ্য কিনে হও ধন্য’ এই আপ্তবাক্যটি মুখে না বলে নেতারা প্রতিপালন করলে দেশের অনেক মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যেত। ১৬ কোটি মানুষের ৩২টি হাত থাকতে কেন আমরা শুধু বিদেশি উৎপাদিত পণ্যের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করব? ভাষার জন্য যে জাতি প্রাণ দিয়েছে তার ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যেন বাজারি আগ্রাসনের মুখে না পড়ে, সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।
৭. আমাদের দেশে একমাত্র উদ্বৃত্ত মানুষ, যা কেবল যোগ্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে মানবসম্পদে রূপান্তরিত হলেই, আমরা সম্পদশালী দেশ হতে পারব। ভারতে আমার সাম্প্রতিক সফরে পত্রপত্রিকায় পড়লাম বিভিন্ন কোম্পানি নতুন স্নাতকদের বেশি বেতন দিচ্ছে—যেন তাদের মধ্যে একটি মর্যাদার প্রতিযোগিতা। আগামী জুনে কোর্স শেষ করা আইআইটি স্নাতকদের সর্বোচ্চ বার্ষিক বেতন কোটি রুপি ছাড়িয়েছে। এই মর্যাদার চাকরি পেতে হাজার হাজার স্নাতক নিজের চেষ্টায় জ্ঞানে দক্ষতায় চলনে-বলনে উচ্চমানের অধিকারী হচ্ছেন। আমরা এখনো আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ বিনিয়োগ ঘটাতে পারছি না। তবে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করে জ্ঞান-দক্ষতা অর্জনে তরুণ, যুবকদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে কাজে লাগাতে পারি। দেশে কি আমাদের এমন একটি প্রতিষ্ঠানও নেই, যারা ছেলেমেয়েদের জ্ঞান-দক্ষতা অর্জনে যথাযোগ্য প্রণোদনার সূচনা করতে পারে?
স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, মানবিক গুণাবলির বিকাশ হোক, আত্মসম্মানবোধে বলীয়ান হোক মন, দেশপ্রেমে আলোকিত হোক আমাদের হূদয়।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।