কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামীরা কি পিছু হঠবে?

সদ্য স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনার রাস্তায় স্পেনের অখণ্ডতার পক্ষে এবার নেমে এল তিন লাখ মানুষ। তাদের সবার মুখে স্লোগান ‘ভিভা এস্পানিয়া’, অর্থাৎ স্পেন দীর্ঘজীবী হোক। সোসাইডা সিভিল কাতালোনিয়া দল এবং স্পেনের ঐক্যে বিশ্বাসী বিভিন্ন দলমতের মানুষের অংশগ্রহণে বিক্ষোভকারীদের দাবি, তারা যেমন কাতালোনিয়ার, তেমনটি স্পেনেরও নাগরিক এবং বার্সেলোনা শহর স্পেনের অংশ।

স্পেনের সংবিধানের ১৫৫ ধারা অমান্য করে ১ অক্টোবর স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে ৯০ শতাংশ ভোটের রায় পাওয়ার পর থেকে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ আর কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনায় হাজার হাজার মানুষ পথে নেমে এসেছেন এবং স্পেন ও কাতালোনিয়ার রাজনীতিকদের সহিংসতার পথ ছেড়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে বলেছেন। কিন্তু জনগণের সেই অব্যক্ত অনুভূতির কথা রাজনীতিকেরা আমলে নিতে পারেননি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কাতালান নেতা কার্লোস পুজেমন আর স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর কৌশলের থেকে রাজনৈতিক জেদ ও অভিলাষের বিষয়টিই সামনে চলে এসেছে।

প্রায় সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যাসমৃদ্ধ স্পেনে সব মিলিয়ে ১৭টি স্বায়ত্তশাসিত আঞ্চলিক পার্লামেন্ট রয়েছে। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে কাতালোনিয়ার সঙ্গে স্পেনের বাকি অংশের একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। স্পেনের ১৭টি রাজ্যের মধ্যে কাতালোনিয়া সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল। সেই হিসাবে তারা এযাবৎকাল কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়ে আসছে, কিন্তু তারা রাজস্ব ও অর্থনৈতিক বিষয় আরও ছাড় দেওয়ার দাবি করে আসছিলে। স্পেনের ১৭টি রাজ্যের মধ্যে বাস্কিয় ও নাভারা রাজ্য দুটিতে আগে থেকেই অধিক স্বায়ত্তশাসন বজায় আছে, নিজেদের অধীনে পুলিশ বাহিনীসহ রাজস্ব আদায়ের বিষয়টিও ওই রাজ্য সরকারগুলোর।

কাতালোনিয়া ২৭ অক্টোবর নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি বা কূটনীতি—এই বিষয়গুলোকে এড়িয়ে জাতীয়তাবোধের অদম্য প্রেরণা থেকে যে স্বাধিকারের ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে কোনো বন্ধু বা প্রতিবেশীরা পাশে নেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাম্প্রতিক সভায়ও কাতালোনিয়া নিয়ে কোনো বড় উদ্যোগ বা সহানুভূতি চোখে পড়েনি বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরও তাতে কেউ সমর্থন জোগাননি।

স্পেনের মোট লোকসংখ্যার ১৬ শতাংশের বসবাস কাতালোনিয়া রাজ্যে, স্পেনের মোট অর্থনীতির ১৯ শতাংশ আয় এই রাজ্যের আর মোট রপ্তানির ২৫ শতাংশ হয় এই রাজ্য থেকে। কিন্তু কাতালোনিয়ার গণভোট ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ইতিমধ্যে ১ হাজার ৭০০ কোম্পানি তাদের সদর দপ্তর বার্সেলোনা থেকে সরিয়ে নিয়েছে।

সেই ২০১০ সালেই স্পেনের সাংবিধানিক আদালত কাতালোনিয়ার অধিক স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের আবেদন বাতিল করে দেন। কাতালোনিয়ার রাজ্য সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ২০১২ সালে আবারও এই ধরনের দাবি তুললে তা মাদ্রিদের কেন্দ্রীয় সরকার দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকটকাল চলছে বিধায় বিষয়টি নাকচ করে দেয়। স্পেনের সংবিধানে অঞ্চলগুলোর স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা থাকলেও স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্বাচন করার কোনো অধিকার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোকে দেওয়া হয়নি।

কাতালোনিয়া রাজ্যের স্বাধীনতার প্রশ্নে বাধাবিপত্তির মুখে ১ অক্টোবরের গণভোটে মাত্র ৪২ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসেন। স্পেনের সংবিধানের ১৫৫ অনুচ্ছেদ ও সাংবিধানিক আদালতের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেই কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক সরকার কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্বাচনে রাজ্যটির ৪২ শতাংশ ভোটারের কাছ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট পেয়ে যায়। আইন ও সংবিধানের চোখে বেআইনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন ৫৮ শতাংশ মানুষ। কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক সরকারের প্রধান কার্লোস পুজেমন অনেক আগে থেকেই কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রবক্তা। গিরোনা শহরের এই সাবেক মেয়র ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আঞ্চলিক পার্লামেন্টের নির্বাচনে স্বাধীনতার প্রশ্ন সামনে এনে ক্ষমতাসীন হন।

১৯ অক্টোবর পর্যন্ত স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয়, কাতালোনিয়ার মুখ্যমন্ত্রী কার্লোস পুজেমনকে দুটি শর্ত দিয়েছিলেন। শর্তগুলো ছিল তাঁরা তাঁদের রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন কি না! আর দ্বিতীয়টি তাঁদের জানাতে হবে, তাঁরা স্পেনের সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে প্রস্তুত আছেন কি না! সময় ও শর্ত বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো কাতালোনিয়ার প্রশ্নে আরও সাংবিধানিক ছাড় বা পরিবর্তনের কথাও ব্যক্ত করেছিলেন।

কিন্তু কাতালোনিয়ার রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের শর্ত দুটি আমলে না নিয়ে ২৭ অক্টোবর কাতালোনিয়ার পার্লামেন্টে রাজ্যটির স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আর তার পরের দিনই মাদ্রিদের কেন্দ্রীয় সরকার স্পেনের সংবিধানিক আইন লঙ্ঘন করে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট ও স্বাধীনতা ঘোষণা করার দায়ে কাতালোনিয়ার রাজ্য সরকারকে বাতিল করে করে আগামী ২১ ডিসেম্বর নতুন করে কাতালোনিয়া রাজ্য পার্লামেন্টের নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। স্পেনের মূলধারার দলগুলোও এই নতুন নির্বাচনের পক্ষে। একটি ভোট জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২১ ডিসেম্বর কাতালোনিয়া রাজ্য পার্লামেন্টে নতুন করে নির্বাচন হলে স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলোর পরাজয় ঘটবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাতালোনিয়া স্বাধীন হলে স্পেনের আদালতের রায় কিংবা স্পেনের সংবিধানের বাধা তারা মানতে বাধ্য নয়। আবার অন্যদিকে, কাতালোনিয়ার অধিকাংশ মানুষ যদি স্পেনের সঙ্গে থাকার পক্ষেই দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে পুজেমনের দেশদ্রোহী হিসেবে দীর্ঘ জেলবাসের সাজা হতে পারে।

মাদ্রিদের কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনিয়ার নেতা কার্লোস পুজেমন সরকারকে বাতিলের পাশাপাশি কাতালোনিয়ার পুলিশপ্রধানসহ ১৫০ উচ্চপদস্থ কমরকর্তার অপসারণ করেছে।

কাতালোনিয়ার গণভোট ও পরবর্তী ঘটনাবলির পর প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয়ের দেওয়া দুটি প্রস্তাব নিয়ে সমালোচনা আছে। এ ধরনের শর্তসাপেক্ষ ও সময় বেঁধে প্রস্তাব না দিয়ে বরং আর কৌশলী ও সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসলে বরং কাতালোনিয়ার পরিস্থিতি স্বাধীনতার ঘোষণায় বাঁক নিত না।

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে স্পেনের জনগণ চায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। ১৯৩৬ থেকে ১৯৭৫ সাল—এই দীর্ঘ সময় গৃহযুদ্ধের হানাহানি তাঁরা দেখেছেন। ১৯৩৬ সালে সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়াই দেশটির দক্ষিণপন্থীরা নির্বাচিত বামপন্থী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে স্বৈরাচার জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর শাসন শুরু হয়। ফ্রাঙ্কো নাৎসি জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির মতো স্বৈরশাসকের সহযোগিতা পেয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করেছিলেন। হিটলার ও মুসোলিনীর বিদায়ের পর ষাটের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সুবিথা পেতে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রাঙ্কোকে মদদ দেয়। ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসন চলে দীর্ঘ সময় ধরে, ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। এই স্বৈরশাসক জেনারেলেরহাত থেকে স্পেনের জনগণকে রক্ষা করতে সেই সময় সার বিশ্বের বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পীরা তাঁদের লেখনী দিয়ে, ছবি এঁকে স্পেনের মুক্তিকামী জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে স্পেনের স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৭৮ সালে স্পেনের গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়।

স্পেনের কালজয়ী শিল্পী পাবলো পিকাসোর শিল্পীজীবনের হাতেখড়ি ও লেখাপড়া কাতালোনিয়া রাজ্যের রাজধানী বার্সেলোনা শহরে। ১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধে গোয়ের্নিকা শহরে বোমাবর্ষণের বীভৎসতায় ব্যথিত হয়ে প্যারিসে বসে বড় ক্যানভাসে জগদ্বিখ্যাত ছবি ‘গোয়ের্নিকা’ এঁকেছিলেন। সেই দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ আর স্বৈরতন্ত্রের পথ পাড়ি দিয়ে দেশটির জনগণ ১৯৭৮ সালে ঐক্যবদ্ধ স্পেনের জন্য যে গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করেছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত সমুন্নত রইবে, না ৪০ বছর আগের তিক্ত গৃহযুদ্ধ পুনরায় দেশটিতে ভর করবে, তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]