সি চিন পিং কী চান?

কেউ জিন
কেউ জিন

অধিকাংশ পশ্চিমা গণমাধ্যম সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চীনের ১৯তম জাতীয় কংগ্রেসকে বিশুদ্ধ ক্ষমতার খেলা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যেখানে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিজের ক্ষমতা আরও সংহত করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পুঁজি সঞ্চয়ের ব্যাপারটা মূলত লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার। সির কাছে এই লক্ষ্যটা হচ্ছে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে আধুনিকতায় রূপান্তর, যার মাধ্যমে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ব আরও সংহত হবে। এবং এর মধ্য দিয়ে আধুনিক চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে তিনি ইতিহাস হয়ে থাকবেন।

সি জানেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে চীনকে সফল হতে গেলে দক্ষতার সঙ্গে কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটাতে হবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। আর চীনের একদলীয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁকে অবশ্যই দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার সংস্কার করতে হবে। বস্তুত তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক সংস্কার অর্থনৈতিক সংস্কারের পূর্বশর্ত।


পশ্চিমের অনেকেই ভুল করে মনে করেন, সি চিন পিং চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাতারে আনার লক্ষ্যে আধুনিকতার অনুসন্ধান করছেন। বরং সত্যটা এর বিপরীত, তাঁর বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও লক্ষ্যের উদ্দেশ্য মূলত অভ্যন্তরীণ। তিনি সফল হলে ইতিহাসে তাঁর স্থান নির্ধারিত হবে—এই বোধ তাঁকে অনুপ্রাণিত করছে।
এটা এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে দেং জিয়াও পিংয়ের পর সি চিন চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা। তাই তিনি এখন নিজের লক্ষ্য অনুসারে ভবিষ্যৎ গড়তে পারেন। ব্যাপারটা হলো, তাঁর পূর্বসূরি হু জিনতাওয়ের এমনটা করার রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না বলে চীন কয়েক দশক ধরে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ওই সময় চীন আপসমূলক কূটনীতি এবং অর্থনৈতিকভাবে রক্ষণশীল কৌশল অনুসরণ করেছে (এতে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছে)।

তবে সির বর্ধিত ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে মেলানো ঠিক হবে না। পলিটব্যুরোতে যেসব সদস্যকে তিনি নিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, তাঁর ক্ষমতার যে একটা সীমা আছে, তিনি সেই বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন। এই কমিটিতে যত সদস্য নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র অর্ধেক তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত। সি যে উত্তরাধিকার রেখে যেতে চান, তার মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে। প্রথমটি হচ্ছে ক্রমবর্ধমান সামাজিক অস্থিরতা দূরীকরণ। মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যের মানোন্নয়নের বাইরে তিনি যে তথাকথিত চীনা স্বপ্নের প্রচারণা চালাচ্ছেন তার আংশিক লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষকে বস্তুগত সম্পদের ঊর্ধ্বে উঠে পূর্ণতা খুঁজতে অনুপ্রাণিত করা।
দ্বিতীয়ত, সি চিন পিং চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করতে চান বলপ্রয়োগ করে নয়, সংস্কারের মাধ্যমে। গত পাঁচ বছরে সি চিন পিং এক অভূতপূর্ব দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন।

এতে নিম্ন স্তরের আমলা থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরের প্রায় ১০ লাখ দলীয় নেতা-কর্মীর পতন হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এ ধরনের বড় প্রচারণা ছদ্মবেশী রাজনৈতিক অপসারণ–প্রক্রিয়া নয়। বরং সি চিন পিং জানতেন, ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের চোখে কমিউনিস্ট পার্টির বৈধতা খাটো হচ্ছিল। দলের ভেতরটা পরিষ্কার করলেই কেবল সি নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।

সি চিন পিং এখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পুনরুজ্জীবনের দ্বিতীয় পর্বের জন্য প্রস্তুত, সেটা
হলো রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার উন্নতি। সি এটা ভালোভাবেই জানেন যে শুধু ঘটনা ধরে ধরে এগোলে ব্যাপক দুর্নীতির মূল কারণ আমলে নেওয়া সম্ভব হবে না। সে লক্ষ্যে পুরো ব্যবস্থার সারাই হওয়া প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘দলের উচিত নিজের শাসন নিজেই পরিচালনা করা।’

প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে আইনি কাঠামোর উন্নতি। অনেক বছর ধরেই জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাব এবং সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া না থাকায় সংস্কার কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন দলীয় কর্মকর্তাদের মাঝে আইনের শাসন প্রয়োগে চীনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দরকার। যদিও বিচার বিভাগ দলের বাইরে স্বাধীন থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।
কিন্তু দক্ষ মানুষ না থাকলে সবচেয়ে উন্নত ব্যবস্থাও কার্যকর হবে না। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম জমানায় সি যে অর্থনৈতিক সংস্কারের তাগাদা দিয়েছেন, তাতেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। সে কারণে সি চিন পিং নতুন প্রজন্মের সুশিক্ষিত, অনুগত ও দুর্নীতিগ্রস্ত নয় এমন একঝাঁক নেতা তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, চীনের সেরা মেধাবীদের বেসরকারি খাতে চলে যাওয়ার রাশ টেনে ধরা।

সি যে ধারা রেখে যাবেন তার তৃতীয় অংশটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, যেটা ইতিমধ্যে কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। ১৯তম জাতীয় কংগ্রেসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে একমত হন যে দলের গঠনতন্ত্রে ‘মাও সে-তুং চিন্তাধারা’ ও ‘দেং জিয়াও পিংয়ের তত্ত্বের’ সঙ্গে ‘সি চিন পিং’ চিন্তাধারা যুক্ত করা হোক।
উদার গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে সি চিন পিং যে রাজনৈতিক আদর্শ প্রস্তাব করেছেন, সেটা এখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ হয়ে উঠছে, তাই এখন সিকে চ্যালেঞ্জ করা মানে দলের বিশ্বাস চ্যালেঞ্জ করা। সংক্ষেপে বললে, সি এখন নিজেকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছেন। বিরল রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে তিনি এখন জাগতিক দেবতায় পরিণত হয়েছেন। সি চিন সুশিক্ষিত এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে অভিজ্ঞ। তিনি অনেক গুরুতর চ্যালেঞ্জ সামলেছেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার ভেস্তে গেলে কী হয়, সেটার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। তাঁর রাজনৈতিক পরিসর অনেক বড়। তবে সেটা শুধু তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে হয়নি, পরিবারের কারণেও হয়েছে, তিনি মাওয়ের এক সহযোদ্ধার সন্তান।

কিন্তু তিনি মাও নন, আর তাঁর মতো করে চীন শাসনও করবেন না। বরং তিনি মাওয়ের ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন, যাতে তিনি চীনকে কার্যকরভাবে ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন। যে ধারা তিনি রেখে যেতে চান, সেটা যেন তিনি নিশ্চিত করতে পারেন, যেটা তাঁর কাছে অনেক মূল্যবান।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

কেউ জিন: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।