আসন্ন সিটি নির্বাচন ও নির্বাচনী সংলাপ

নির্বাচন কমিশনকেও দৃঢ়চিত্ত হতে হবে
নির্বাচন কমিশনকেও দৃঢ়চিত্ত হতে হবে

বিগত কয়েক মাস নির্বাচন কমিশন আধুনিক নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় শরিক বলে বিবেচিতদের সঙ্গে সংলাপ করেছে। সংলাপ করেছে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দল এবং সাবেক কমিশনারসহ আরও বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে। এর মধ্যে আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ। যদিও সংলাপের আদ্যোপান্ত ছিল বেশ মোটাদাগের, তথাপি এ সংলাপের মাধ্যমে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উঠে এসেছে, যার বিশ্লেষণ ও প্রয়োগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে তার মন্তব্য, বক্তব্য ও প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে। এ ধরনের কাঠামোগত সংলাপের সূত্রপাত হয়েছিল ২০০৭-২০০৮ সালে। তবে ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি, যা থাকা উচিত ছিল। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগের আনুষ্ঠানিক কোনো কাঠামো নেই। অনেক নতুন গণতান্ত্রিক দেশে কাঠামোগত সংলাপের বিষয় আইনেই উল্লেখ রয়েছে, যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যথা আইন ও নির্বাচন কাঠামোর আলোচনা প্রাধান্য পায়।

এ ধরনের সংলাপের মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে শরিকদের, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের যোগাযোগ যেমন বজায় থাকে, তেমনি নির্বাচন কমিশনের ওপর শরিকদের আস্থা বাড়ে। এখানেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ইতিবাচক প্রাপ্তি। এই সংলাপের মাধ্যমে বর্তমান কমিশনের ওপরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আস্থা রাখতে শুরু করেছে। প্রথম দিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওপর কিছুটা অনাস্থা প্রকাশ করলেও ধারণা করা হয় সে অনাস্থা সংলাপের পর অনেকটাই দূর হয়েছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের প্রধান সংকট ভোটার এবং শরিকদের আস্থা-অনাস্থা। এরই কারণে অনেক সময় সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও অনাস্থার কারণে সহজে মেনে নিতে চায় না, বিশেষ করে নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ও দলগুলো। অপর দিকে এ পর্যন্ত যেসব নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল, সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বেশ কয়েকটি কমিশনের ওপর প্রাথমিক আস্থা স্থাপন করলেও নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কারণ, যার মধ্যে অন্যতম অন্তর্দ্বন্দ্ব, নির্বাচনকালীন সরকারের বা সরকারি দলে নির্বাচনকে অনুকূলে রাখার প্রচেষ্টাও নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাহীনতার কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। অতীতের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে তেমনই মনে হয়।

অতীতেও যে কয়টি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়োছিল, সেগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। যদিও পরাজিত দল প্রতি নির্বাচনেই ফলাফল একবাক্যে গ্রহণ করেনি। বস্তুতপক্ষে এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। এর পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না এবং হওয়ার সম্ভাবনাও কম। অপর দিকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে কোনো নির্বাচনই ন্যূনতম মানে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করলেই এ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে এর ধারাবাহিকতার কোনো পরিবর্তন হবে কি না তা প্রত্যক্ষ করতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত হয়তো অপেক্ষা করতে হবে।

যদিও সামনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন রয়েছে, যার প্রথম ধাপে রয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন, যেটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে। ইতিপূর্বে বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের দেড় মাসের মধ্যেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৩০ মার্চ ২০১৭ সালে। নির্বাচনটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। যদিও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো, অন্যান্য দেশের মতো একটি দলের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি নয়, তথাপি বর্তমান ব্যবস্থাপনায় দলীয় সরকারের নিচে দলীয়ভাবে এসব নির্বাচনের ফলাফল সে ধরনের মাপকাঠি হয়ে উঠতে পারে। কাজেই একইভাবে এসব নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে এবং এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর ভোটার ও সাধারণ জনগণের জন্য আস্থার মাপকাঠিও হতে পারে।

নিকট অতীতের জাতীয় সংসদ নির্বাচন তারই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর কারণে বৃহত্তর সংখ্যক মানুষের মনে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা এবং নির্বাচন কমিশনের কার্যক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যারা ২০১৪ সালের পর থেকে ভোট প্রদান করতে পারেনি, তাদের মনে শঙ্কা থাকাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে সাধারণ নির্বাচনের বেলায়। একইভাবে অতীতের নানা ধরনের ব্যর্থতার কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে মানুষের মনে সংশয়।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হয় যে কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলে সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কী করণীয় ছিল? এর উত্তরে বলতে হয়, হয়তো আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের কিছু করার চেষ্টাও চোখে পড়েনি, তদুপরি যতটুকু নির্বাচন হয়েছে সেখানেও নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছিল। এর পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে যেভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ হয়েছিল, নির্বাচন কমিশনের প্রচুর ক্ষমতা থাকলেও সে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর কারণেই প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচনী দুর্নীতির এবং ব্যর্থ নির্বাচনের সংজ্ঞায় যেসব উপাদানের উপস্থিতির কথা উল্লেখ রয়েছে, তার সবটুকুই দৃশ্যমান ছিল।

যাহোক বড় প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব কি না। এর উত্তর পাঠকমাত্রই জানেন। তবু বলতে হয় যে মোটেও না। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার শরিক এবং দলীয় সরকার না চাইলে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কথা বাংলাদেশের ভোটারমাত্রই জানেন। তবে আমি মনে করি, এমন পরিবেশে কঠিন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগেও যদি ব্যর্থতা লক্ষিত হয়, তবে সে ক্ষেত্রে দায়ভার নির্বাচন কমিশনের ওপরেও অনেকাংশে বর্তায়।

আমরা প্রায়ই ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের উদাহরণ দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সন্দেহ নেই যে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ‘প্রচণ্ড স্বাধীন’সত্তা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আইন, বিধি ও আইনি ক্ষমতার নিরিখে বাংলাদেশ উপমহাদেশের নির্বাচন কমিশন সবচেয়ে ক্ষমতাধর হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যত কয়েকটি ছাড়া আমাদের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে যথেষ্ট দুর্বলতার নিদর্শন পাওয়া যায়। অথচ ভারতেও নির্বাচন কমিশনের নিয়োগও বাংলাদেশের নিয়োগপ্রক্রিয়ার মতোই, ক্ষমতাসীন সরকার দ্বারাই নিয়োজিত হয়ে আসছে। যদিও সংবিধানে আইন তৈরির কথা বলা আছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এই উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ নির্বাচন কমিশন, যার রয়েছে তিন হাজারের বেশি লোকবল, উপজেলা পর্যন্ত স্বতন্ত্র অফিস এবং একটি স্বাধীন সচিবালয়, যা মাঠ পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। এত কিছুর পরও আমরা কেন সবচেয়ে দুর্বল বলে প্রমাণিত হই?

ওপরের প্রশ্নের উত্তর আমার জানা থাকলেও ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওপর ভারতের সদ্য অবসর নেওয়া রাষ্ট্রপতি ও উপমহাদেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জির মুখে শুনেছিলাম, তাঁর সঙ্গে আমার এক বিরল সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল ভিত হচ্ছে ক্রমাগত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং যার দায়দায়িত্বের প্রধান প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। তিনি আরও বলেছিলেন যে ১৯৫২ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কাজকে কোনো সরকার প্রভাবিত করার চেষ্টাই করেনি এবং করা সম্ভবও নয়। কারণ, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে উচ্চ আদালতগুলো যখন নির্বাচন কমিশনের সহায়ক।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনকেও দৃঢ়চিত্ত হতে হবে। তিনি অবশ্য টি এন সেশানের নামও উল্লেখ করেছিলেন। একইভাবে তিনি ১৯৭৫ সালে তাঁর দলের প্রধানমন্ত্রী রায়বেরেলির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কীভাবে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, সে কথা বলতে ভোলেননি। তাঁর কথার সারমর্ম হলো যে ভারতের বিচারব্যবস্থা ইন্দিরা গান্ধীর মতো লৌহমানবী ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করে আনুকূল্য নিয়ে জয়ী হওয়ায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট ছয় বছরের জন্য নির্বাচনে অনুপযোগী ঘোষণা করেছিলেন। এ বিষয়টি এখন ইতিহাস হয়ে রয়েছে। আমরা কি সে অবস্থানে রয়েছি? আমাদের বিচার বিভাগ নির্বাচন কমিশনের সহায়ক শক্তি হিসেবে যত দিন না দাঁড়াবে, তত দিন নির্বাচন কমিশনও শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে বলে মনে হয় না। অন্তত অতীতে তেমনটা দেখা যায়নি। বিচার বিভাগ নির্বাচন কমিশনের অন্যতম বড় সহায়ক শক্তি।

ওপরের আলোচনার আলোকে বলা যায় যে প্রায় সময়েই আমাদের নির্বাচন কমিশনকে একলাই চলতে হবে আর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিদেনপক্ষে নিজস্ব শক্তিমত্তার প্রদর্শন করতে হবে। স্মরণযোগ্য যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ এবং আস্থার পরিবেশ তৈরির মতো দুরূহ কাজটি নিজ ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে থেকেই করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য সহায়ক শক্তির সহায়তার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে আর তা পাওয়া না গেলে নিজের ক্ষমতায় যতটুকু সম্ভব ততখানিই করতে হবে। প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে তার, প্রয়োজনে প্রয়োগই হবে নির্বাচন কমিশনের কাজ। যে নিরিখে রংপুরসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে পারে পরীক্ষার ক্ষেত্র।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।