জলবায়ু বিমা: ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঋণে জড়ানোর কৌশল?
ট্রাম্প সাহেব যতই অস্বীকার করুন, প্রকৃতি শোধ নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রকৃতির সেই প্রতিশোধ। বুঝিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবী সর্বংসহা তো নয়ই, বরং মানুষের অত্যাচারে তার অবস্থাও মুমূর্ষু। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলার নামে চালানো নতুন বাণিজ্য, যার নাম দেওয়া হয়েছে জলবায়ু বিমা।
আগাম ও অতিবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশ এবার বন্যায় ভেসেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় আগাম বন্যা হয়েছে। ফি বছরই এ ধরনের বন্যা হাওরে হয়ে থাকে। এর জন্য স্থানীয় কৃষকদের প্রস্তুতিও থাকে। রয়েছে তাঁদের নিজস্ব অভিযোজন জ্ঞান ও পদ্ধতি। তবে এ রকম আগাম ঢলের জন্য কেউই তৈরি ছিল না। বাংলাদেশের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এবারের আগাম ঢলে ফসলহানি ঘটেছে চার লাখ হেক্টর জমিতে দুই মিলিয়ন টনের মতো। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরও জানিয়েছে, এবারে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অতিবৃষ্টির কারণেই আগাম ঢলে কৃষকদের এই ক্ষয়ক্ষতি।
জার্মানির বন শহরে জলবায়ু সম্মেলন চলছে। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতিতে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয় নিয়েই উন্নত ও অনুন্নত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে দর-কষাকষি হয়েছে। জলবায়ুজনিত ক্ষয়ক্ষতির জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি ২০১২ সালে ওয়ারশো সম্মেলনেই উত্থাপিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্যারিস চুক্তিতে এটি সন্নিহিত করা হয়। অনেকেই আশাবাদী ছিলেন, এবারের সম্মেলনে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত আসবে, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
কিন্তু সম্মেলনে এ-বিষয়ক সিদ্ধান্ত আমার মতো অনেককেই হতাশ করেছে। সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির জন্য উন্নত বিশ্ব থেকে আর্থিক সহায়তা-প্রত্যাশীকে বিমা করতে হবে। বিমা না করলে কোনো আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কীভাবে নিরূপণ করা হবে, সেটিই এখনো ঠিক করা হয়নি। আর আগে বিমা করার বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হলো। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, কে বিমা করবে? সরকার, না ভুক্তভোগী হাওর অঞ্চলের কৃষক। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশে শস্যবিমা চালু করা হয়েছিল। এটি খুব একটা সফল হয়নি। এখন যদি আবার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যার জন্য বিমা করতে হয়, তা কৃষকদের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা হবে। এবং এতে করে কি কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও থেকে যায়?
বন সম্মেলনের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো আদৌ কোনো আর্থিক সহায়তা পাবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই গেল। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) যা গঠন করা হয়েছে, তা আসলে অনেকটাই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ডারবান সম্মেলনে ১০০ বিলিয়ন ডলারের জিসিএফ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ও হয়েছে। এই তহবিলকে আবার দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রশমন ও অভিযোজন খাতের জন্য। ৫০ শতাংশ অর্থই প্রশমনের জন্য দেওয়া হচ্ছে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রশমনের জন্য এ তহবিল থেকে প্রকল্প ঋণ দেওয়া হয়েছে। আবার অভিযোজনের জন্য তহবিল প্রদানে অবলম্বন করা হচ্ছে ধীরে চলো নীতি। ২০১৫ সালের অভিযোজনের জন্য আটটি প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের একটি প্রকল্প মনোনীত হয়। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে তহবিল পায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি ঋণ নেবে? বা কেন নেবে? বাংলাদেশ তো অধিক হারে গ্যাস নিঃসরণ করে না। বাংলাদেশের দরকার অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উন্নত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনে আর্থিক সহায়তার পরিবর্তে এখন অনুন্নত বিশ্ব থেকেই বিমার নামে অর্থ হাতিয়ে নেবে। অনেক দিন ধরেই উন্নত বিশ্ব জলবায়ুর তহবিল-প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকে ঢোকানোর চেষ্টা করছিল। ক্ষয়ক্ষতির জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানে বিমার বিষয়টি বেসরকারি খাতের প্রবেশ সহজ করে দেবে। অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না যদি সহসাই ইউরোপ-আমেরিকার বড় বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন বিমা পলিসি নিয়ে অনুন্নত দেশের দুয়ারে হাজির হয়।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, অনুন্নত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো উন্নত বিশ্বের চাপিয়ে দেওয়া এই নীতি মেনেও নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আবার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে এনজিওগুলো। তাহলে এই যে বছর বছর এত বড় বড় দল নিয়ে গরিব রাষ্ট্রগুলো সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে, তাতে কী ফল হচ্ছে? উন্নত বিশ্ব ঠিকই তাদের সিদ্ধান্ত বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে উন্নত বিশ্বের পক্ষে মাঠপর্যায়ের কাজ আগাম করে দিচ্ছে কিছু কিছু এনজিও। আসলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যে বিশাল বহর নিয়ে সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে, সেখানে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারছে না। বা জলবায়ু সম্মেলনে এনজিওগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল জনসাধারণের মতামত আলোচনায় ঠিকমতো প্রতিফলিত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য। এ পর্যন্ত গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তারও কোনো প্রতিফলন নেই।
জলবায়ু সম্মেলন আসলে সাধারণ জনসাধারণের জন্য কোনো কিছুই দিতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন ও সফল হওয়ার কোনো কারণও নেই। এত দিন ধরে আর্থিক ক্ষতিপূরণ লাভের যে স্বপ্ন দেখিয়ে এনজিওগুলো সম্মেলনে সদলবলে অংশ নিল এবং অনুন্নত বিশ্বকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করল, তাতে কোনো লাভই হলো না। আমি বলছি না যে আর্থিক সহায়তাই জলবায়ু সম্মেলনের মুখ্য বিষয়; বরং গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করাই ছিল মুখ্য। কিন্তু সেখান থেকে জলবায়ু সম্মেলন এখন অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে। বরং আর্থিক সহায়তার নামে অনুন্নত বিশ্বকে ঋণ ও বিমার জালে আবন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। আর জেনে হোক বা না বুঝেই হোক, উন্নত বিশ্বের প্ররোচনায় বাংলাদেশসহ অনুন্নত বিশ্ব সেই ফাঁদেই নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলছে।
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসানর্স, জার্মানি