চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ চাই

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে প্রথম আলোর কার্যালয়ে গত ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে প্রথম আলোর কার্যালয়ে গত ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো

গত ১৪ অক্টোবর ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘চট্টগ্রাম বন্দর: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো। 

আলোচনায় সুপারিশ

* দ্রুত গ্যান্ট্রি ক্রেন সংগ্রহ ও ইয়ার্ড নির্মাণ। পতেঙ্গা টার্মিনালের কাজ দ্রুত শেষ করার পাশাপাশি আরও দুটি টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া

* বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য লাইটার জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো এবং পণ্য খালাসের যন্ত্রপাতি ও ঘাটের আধুনিকায়ন শুরু করা

* পণ্য খালাসের জন্য বন্দর ফটকের ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের কাজ শুরু করা

* এখনই ৫০ বছরমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ

* বেসরকারি ডিপোর সংখ্যা বাড়ানো

* যাঁরা বেশি পণ্য আমদানি করেন, তাঁদের জন্য পণ্য খালাসের ঘাট বা জেটি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া

* পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে যতটুকু সম্ভব বন্দরের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করা

* বন্দর চত্বর থেকে কনটেইনার পণ্য দ্রুত খালাসের জন্য কাস্টম হাউসে স্ক্যানারের সংখ্যা বাড়ানো

* বন্দরের দক্ষিণ আবাসিক এলাকা ভেঙে নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ করা। কর্মকর্তাদের জন্য বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ করা

* প্রতিনিয়ত বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া

আলোচনা

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার। দেশের সিংহভাগ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় এই বন্দর দিয়ে। সম্প্রতি এই বন্দরে জাহাজজট, দুর্ঘটনা, অবকাঠামোর অপ্রতুলতাসহ নানা সংকট দেখা দিয়েছে। আবার কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ-আয়োজনও দেখছি আমরা। এসব বিষয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে শুনতে চাই। নীতিনির্ধারকদের কাছে তা তুলে ধরতে চাই।

লাজ্জাত এনাব মহছি: প্রথম আলো নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যা-সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছে। চট্টগ্রাম বন্দর স্থানীয় কোনো ইস্যু নয়। এটি জাতীয় বিষয়। চট্টগ্রাম বন্দর পিছিয়ে পড়লে দেশের অথর্নীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশ পিছিয়ে যাবে। আমরা দেখছি, বর্তমানে দেশে প্রতিনিয়ত ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কি প্রস্তুত? বন্দর যে কিছুই করছে না সেটা বলছি না। রুটিন (নিয়মিত) কাজগুলো করছে। কিন্তু যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে যাচ্ছে, সেভাবে এগিয়ে নেওয়া বা প্রস্তুত করা, সক্ষমতা বাড়ানো হলো আসল কথা। এই বন্দরের বর্তমান সমস্যা কী কী? সমাধানে করণীয় কী? আলোচকদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা আমরা জানতে চাই।

আহসানুল হক চৌধুরী
আহসানুল হক চৌধুরী

আহসানুল হক চৌধুরী: আমরা এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় আছি, আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আগে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দর থেকে একটি জাহাজ মাসে তিনবার পণ্য আনা-নেওয়া করত। জাহাজজটের কারণে এখন দুবারের বেশি সম্ভব হচ্ছে না। দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন অচল হয়ে পড়ায় ক্রেনবিহীন জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়েছে। এই গ্যান্ট্রি ক্রেনগুলো কখন ঠিক হবে জানি না। ক্রেনবিহীন জাহাজ পরিচালনায় খরচ পড়ে কম। ফলে কনটেইনার পণ্য পরিবহনে ভাড়াও তুলনামূলক কম হতো।
বন্দর জেটিতে এখন কনটেইনারবাহী জাহাজগুলোকে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার বেশি অবস্থানের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বন্দরে যন্ত্রপাতির সংকট ও বন্দর চত্বরে জটসহ নানা সমস্যার কারণে কিন্তু অনেক সময় ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার নামাতে হয়। ফলে অনেক সময় জাহাজে রপ্তানি কনটেইনার পুরোপুরি বোঝাই করা যাচ্ছে না। রপ্তানি পণ্য না নিয়ে অনেক সময় জাহাজকে বন্দর ছেড়ে যেতে হচ্ছে। এ সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার রাখার জন্য বন্দরে আলাদা চত্বর তৈরি করার কথা জানিয়েছি। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। জাহাজের মালিকেরা বাড়তি খরচ হলে তাঁরা নিজেরা দেন না। তা আমদানিকারকদের পরিশোধ করতে হয়। আমদানিকারকেরা ভোক্তাদের কাছ থেকেই তা আদায় করেন।
আরেকটি কথা, বন্দর চত্বর থেকে আমদানিকারকদের পণ্য খালাসের হার বাড়ছে না। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম চেম্বার ভূমিকা রাখতে পারে। দ্রুত পণ্য খালাস করার জন্য ব্যবসায়ীদের তাগাদা দিতে পারে।

খায়রুল আলম
খায়রুল আলম

খায়রুল আলম: অনেক দিন ধরে আমরা বলছি, লালদিয়াসহ যেসব টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কাজ শেষ করুন। ২০১০ সাল থেকে ব্যবসায়ীরা বারবার এসব কথা বলে আসছেন। এসব টার্মিনালের একটিও যদি শেষ হতো, তাহলে আজকে এ অবস্থা হতো না।
ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের পক্ষ থেকে আমি বলব, এলসিএল কনটেইনার (এক কনটেইনারে একাধিক আমদানিকারকের পণ্য) ব্যবস্থাপনা বড় সমস্যা বন্দরের। এ ধরনের কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানোর পর কনটেইনার খুলে বন্দরের শেডে রাখা হয়। এরপর শেড থেকে আমদানিকারকেরা খালাস করে নেন। এসব পণ্য নেওয়ার জন্য প্রতিদিন সহস্রাধিক ট্রাক বন্দরে আসা-যাওয়া করে। বন্দরের যদি মূল চত্বর থেকে এসব কনটেইনার সরিয়ে আশপাশের চত্বর তৈরি করে রাখা যেত তাহলে বন্দরে গাড়ির জট হতো না।
কাস্টমসে স্ক্যানার সংকটের কারণেও বন্দরের কনটেইনার খালাসে সময় লাগছে। ডিপো ও ইপিজেডগামী কনটেইনার বন্দর থেকে খালাস নেওয়ার আগে স্ক্যানিং করাতে হয়। মাত্র চারটি স্ক্যানার দিয়ে এই স্ক্যানিং কার্যক্রম চলছে। চট্টগ্রাম চেম্বার থেকেও সহযোগিতা করা হবে বলে জানানো হয়েছে রাজস্ব বোর্ডকে। এরপরও স্ক্যানারের সংখ্যা বাড়েনি।

হাদী হোসাইন
হাদী হোসাইন

হাদী হোসাইন: প্রথমেই বন্দরের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা দিয়ে শুরু করি। এই বন্দরে জাহাজ চলাচল নির্ভর করে জোয়ার-ভাটার ওপর। জোয়ারের সময় সাগর থেকে জেটিতে জাহাজ আসা-যাওয়া করে। সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচল করে। সাগর থেকে বন্দর জেটিতে জাহাজ আনা-নেওয়ার সময় তিনটি বাঁক রয়েছে, যে কারণে বড় আকারের জাহাজ জেটিতে আনা যায় না।
এখন অবকাঠামোর সমস্যার কথা বলি। বন্দরের বোর্ড সদস্য হিসেবে থাকার সময় পুরোনো তিনটি জেটি ভেঙে কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। আবার নিউমুরিং টার্মিনাল নির্মাণ হলেও ২০০৭ সালের পর থেকে গ্যান্ট্রি ক্রেন যুক্ত হয়নি। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই গ্যান্ট্রি ক্রেন ও কেসিটি টার্মিনাল নির্মাণ হলে এখন বন্দরে এত সমস্যা হতো না। জেটি ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি বন্দরের ডক লেবার কলোনি এলাকায় কনটেইনার রাখার জন্য ‘ওভার ফ্লো ইয়ার্ড’ নির্মাণে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করেছে। এটি আরও আগে নির্মাণ শুরু করা উচিত ছিল।
বন্দর থেকে এখন নদীপথে কনটেইনার পরিবহন হচ্ছে। কনটেইনার পরিবহনে রেলেরও সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। বন্দরের পর্ষদকে অবকাঠামো উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা এবং যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হোক। আর্থিক ক্ষমতা বাড়লে কেনাকাটার জন্য ফাইল চালাচালি করতে হবে না।
বন্দরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন কার্যক্রম হাতে নেওয়া থেকে বন্দরের বিরত থাকা উচিত। বন্দরের উচিত হবে, পণ্য পরিবহনের সুবিধা বাড়ানোর কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পোর্ট কাউন্সিল গঠন করা যায় কি না, ভেবে দেখা দরকার।

নাসরিন সারোয়ার
নাসরিন সারোয়ার

নাসরিন সারোয়ার: জাহাজ আসার পরও সময়মতো পণ্য হাতে না পাওয়া এখন মূল সমস্যা। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাসের ক্রেন সংগ্রহ করা দরকার। পণ্য পরিবহন বাড়ার সঙ্গে বন্দর কতটা প্রস্তুত আছে, তা জানতে পারছি না আমরা। ফলে স্বস্তিও পাচ্ছে না কেউ। পণ্য পরিবহন বাড়ার সঙ্গে দিন দিন বন্দরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বন্দরে জাহাজে কোনো দুর্ঘটনা হলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্যবস্থা রাখা উচিত।

খন্দকার লতিফুর রহমান
খন্দকার লতিফুর রহমান

খন্দকার লতিফুর রহমান: রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের প্রায় ৯৫ শতাংশ সরঞ্জাম সরবরাহ করছি আমরা (এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন)। পোশাক কারখানা থেকে এসব সরঞ্জাম সরবরাহের আদেশ পাওয়ার পর বিদেশ থেকে কাঁচামাল কারখানায় এনে প্রস্তুত করতে হয়। বন্দরের জটের কারণে যখন সময়মতো কাঁচামাল হাতে পাই না, তখন নির্ধারিত সময়ে সরঞ্জাম প্রস্তুত করা যায় না। এ কারণে বেশ কিছুদিন যাবৎ সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রপ্তানি-আদেশ হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা ঘটছে। আবার সঠিক সময়ে পোশাক কারখানায় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে না পারলে তারা আমাদের কাছে ক্ষতিপূরণও চাইছে।
সব প্রক্রিয়া শেষ করে এখন ট্রাক নিয়ে বন্দরে কনটেইনার পণ্য খালাস নিতে গেলেও এক দিন দেরি হচ্ছে। যন্ত্রপাতির অভাবে এটি হচ্ছে। এতে খরচও বাড়ছে।

আবুল বশর চৌধুরী
আবুল বশর চৌধুরী

আবুল বশর চৌধুরী: পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে বন্দরের সক্ষমতা ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে কি না, সন্দিহান আমরা। পণ্য পরিবহন বাড়লেও গত ১০ বছরে জেটি হয়নি। বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি পণ্য আসে কনটেইনারবিহীন জাহাজে। দেড় বছর আগে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টনের একটি বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করতে সর্বোচ্চ ২৫ দিন সময় লাগত। এখন ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ দিন সময় লাগছে। অথচ বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া কনটেইনারবিহীন খোলা পণ্যের ৭০ শতাংশ বহির্নোঙরে খালাস করতে হয়। এ জন্য দরকার লাইটার জাহাজ। অথচ এই লাইটার জাহাজের নির্মাণের অনুমোদন দেড় বছর বন্ধ রাখা হয়েছে। সম্প্রতি লাইটার জাহাজের নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে শুনেছি। কেন দেড় বছর বন্ধ রাখা হলো, তা রহস্যজনক।
লাইটার জাহাজের পাশাপাশি ঘাটে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য নামানোর জন্যও আধুনিক ব্যবস্থা নেই। চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীপথে ঘাটের সংখ্যাও খুব বেশি বাড়েনি। আবার খাদ্যশস্যবাহী জাহাজও জেটিতে ভেড়ানোর জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়।
হিসাব করলে দেখা যাবে, বন্দরে এখন যত জাহাজ আসছে, ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে তার পণ্য খালাসে বিলম্বের জন্য আমদানিকারককে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। এই ক্ষতিপূরণের টাকা বিদেশি মুদ্রায় চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। পাশাপাশি কাঁচামাল না পেয়ে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হওয়ার নজির রয়েছে।
পণ্য খালাসে দেরি হওয়ার কারণে এখন ভাড়াও বেশি গুনতে হচ্ছে। আগে অস্ট্রেলিয়া, প্যাসিফিক ও ব্ল্যাক সি অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য আমদানিতে যেখানে টনপ্রতি ২৭-২৮ ডলার ভাড়া দিতে হতো, এখন তা টনপ্রতি ৫ ডলার বেড়ে গেছে। এখানে অনিশ্চয়তার জন্য এই ভাড়া বেড়েছে।
আমরা নিজেরা বছরে ৭-৮ লাখ টন পণ্য আমদানি করি। এখন বছরে ১০-১২ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। বড় জাহাজ বেশি সময় অবস্থানের জন্য এবং লাইটার জাহাজ থেকে ঘাটে পণ্য খালাসের সুযোগ কম থাকায় এই ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে।

আমাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। পণ্য পরিবহন বাড়তে থাকায় সমুদ্রগামী জাহাজ ভেড়ানোর জেটি, বহির্নোঙর থেকে পণ্য খালাসের জন্য লাইটার জাহাজ ও দেশের নানা স্থানে পণ্য খালাসের ঘাটের সংখ্যা বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। প্রয়োজনবোধে যাঁরা বেশি পণ্য আমদানি করেন, তাঁদের নিজস্ব অর্থায়নে জেটি-ঘাট নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া উচিত। কনটেইনার জাহাজেও ভোগ্যপণ্য আমদানি করি আমরা। কনটেইনার পণ্য খালাসেও ভোগান্তির কমতি নেই।

বন্দরের প্রস্তাবিত ‘বে টার্মিনাল’ নির্মাণের প্রক্রিয়াগত কাজে কেন দেরি হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। দীর্ঘসূত্রতা যাতে না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। পণ্য খালাসে আধুনিকায়ন ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি সংযোজন করা উচিত। লাইটার জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। বন্দর সক্ষমতা অর্জন করলে জিডিপি ১ থেকে ২ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব।

রোজিনা আক্তার
রোজিনা আক্তার

রোজিনা আক্তার: চলতি বছরের মে মাস থেকে জাহাজজট চলছে। যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। জেটির সংকট তো অনেক দিনের। কথা হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করার ১৩০ বছর পরও কেন এই বন্দরে যন্ত্রপাতির সংকট, জেটির সংকটের কথা শুনতে হবে। ২০২১ সালে ৬০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বন্দর ঠিক না থাকলে এই লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন হবে? বন্দরে আধুনিক গ্যান্ট্রি ক্রেন দরকার ২৬টি। এখন আছে ৪টি। এমন অনেক সংকট আছে, যা বন্দর কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজে সমাধান সম্ভব।
আমরা জানি, এই বন্দর দিয়ে সারা দেশের সমুদ্রপথের আমদানি-রপ্তানি ৯২ শতাংশ সম্পন্ন হয়। এর অর্থ অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে কি না, তার অনেকটাই নির্ভর করে এই বন্দরের গতিশীলতার ওপর।
তবে শুধু এই বন্দরের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। মোংলা বন্দরকে আরও কার্যকর করতে হবে। পায়রা বন্দরের কথা বলা হলেও তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। নতুন বন্দর চালুর পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

মুহাম্মদ সিকান্দর খান
মুহাম্মদ সিকান্দর খান

মুহাম্মদ সিকান্দর খান: খুব দুঃখ লাগে, যখন একজন মন্ত্রী বন্দরের ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। আমাদের যোগ্য মানুষকে যোগ্য জায়গায় দিতে হবে। কাউকে এমন একটি দায়িত্ব দেওয়া হলো, যাতে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হতে পারে, তাঁকে সেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়।
যা হোক, চট্টগ্রাম বন্দর পিছিয়ে পড়ার দুটি তত্ত্ব রয়েছে বলে মনে করি। একটি হচ্ছে অদক্ষতা তত্ত্ব, আরেকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। অদক্ষতা তত্ত্ব হচ্ছে সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখে চট্টগ্রামকে দাবিয়ে রাখা। এ জন্য সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য জায়গায় নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হচ্ছে চট্টগ্রামকে এড়িয়ে দেশের অন্য এলাকায় কম সুবিধাজনক স্থানে বন্দর গড়ে তোলার চেষ্টা। চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা বাড়াতে যত খরচ হবে, অন্য জায়গায় এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি খরচ হবে এমন প্রকল্পও নেওয়া হচ্ছে।
বন্দরের জায়গা কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে বরাদ্দের বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। ভবিষ্যতে বন্দরের সম্প্রসারণের জন্য জায়গা থাকছে কি না দেখতে হবে। কাউকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হলে বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছে কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা করা উচিত।
বন্দরে যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো সমাধানের জন্য শুধু শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। যে যে অবস্থানে আছে, সেই অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

নাসির উদ্দিন চৌধুরী
নাসির উদ্দিন চৌধুরী

নাসির উদ্দিন চৌধুরী: বন্দর কর্তৃপক্ষ বা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই আমাদের প্রতিপক্ষ নয়, সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ভালো চললে জাতীয় অর্থনীতি উপকৃত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি কম হয়। খারাপ চললে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই বন্দর প্রশাসন কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন। হওয়া উচিত ছিল সহযোগিতামূলক, অংশীদারত্বমূলক ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন। কারণ, কয়েক বছর ধরে বন্দর ব্যবহারকারী মূল ১২-১৪টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বন্দর প্রশাসন যদি নিবিড়ভাবে কাজ করত, তাহলে দক্ষতা বা সক্ষমতা আজকে এ জায়গায় নেমে আসত না।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় যখন অহংকার করে বলে, প্রতিবছর বন্দরে পণ্য পরিবহনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১৬-১৮ শতাংশ হারে, তখন তা শুনতে ভালো লাগে। এই প্রবৃদ্ধির জন্য বন্দরের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানো দরকার ছিল ২০ শতাংশ হারে। এটি খুব সহজ ভাষায় বোঝার কথা ছিল। কিন্তু তারা বুঝল না কেন? এই না বোঝার খেসারত দিচ্ছি আমরা।
পোশাক খাত নিয়ে বলি, সিঙ্গাপুর থেকে চার দিনে কোনো পণ্য এসে যখন বহির্নোঙরে ১০ দিন পড়ে থাকে, তখন লিড টাইম (পণ্য রপ্তানির সময়সীমা) নিয়ে আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। দেরিতে কারখানায় কাঁচামাল পৌঁছার কারণে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করা যায় না। অথচ পোশাক খাতের প্রতিযোগী দেশগুলো ঘণ্টায় ঘণ্টায় কাঁচামাল খালাসের সুযোগ পাচ্ছে।
এ বছর প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কারখানায় কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন নিয়ে যুদ্ধ করছে। সংকটের মাঝে যাচ্ছে পোশাক খাত। এর মধ্যে বন্দরের কারণে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। সারা দেশে হাজার দেড়েক, চট্টগ্রামে ৩০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এটার জন্য অনেক কারণের মধ্যে বন্দরের বর্তমান অবস্থাও দায়ী।
এই অবস্থায় জবাব দেওয়ার তো কেউ নেই। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন থাকলে আমরা জানাতে পারতাম, পণ্য হাতে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় বছরে এত টাকা ক্ষতি হয়ে গেল। এ জন্য জবাবদিহির জায়গাগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
পায়রা বন্দর নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর মনোযোগ হারিয়েছে। না হলে এত প্রবৃদ্ধি থাকার পর এত দীর্ঘ সময়েও কেন গ্যান্ট্রি ক্রেন সংগ্রহ হলো না? আমার মনে হয়, যে পরিকল্পনা নেওয়া হয় তার ২০ শতাংশও বাস্তবায়ন হয় না। এ জন্য ব্যবসায়ীদের এক জায়গায় এসে উচ্চকণ্ঠে বলতে হবে। তাহলে নীতিনির্ধারকেরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

এস এম আবু তৈয়ব
এস এম আবু তৈয়ব

এস এম আবু তৈয়ব: জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য ব্যবহৃত গ্যান্ট্রি ক্রেন কেনার প্রক্রিয়া চলতে চলতে অনেক বছর গেছে। কিন্তু গ্যান্ট্রি ক্রেন আর আসে না। কোনো শিল্পকারখানায় যন্ত্রপাতির সমস্যা হলে দ্রুত যন্ত্রপাতি এনে কারখানা চালু করতে দিন-রাত পরিশ্রম করেন উদ্যোক্তারা। নিজের প্রতিষ্ঠান বলে তাঁরা এসব করছেন। বন্দর প্রশাসনে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও এটি নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে কাজ করতে হবে।
বয়সের হিসাব করা হলে বাংলাদেশের বড় ছেলে এই চট্টগ্রাম বন্দর। এখন ছোট ছেলে বা মেয়ের মতো পায়রা বন্দরের জন্ম হয়েছে। আমরা কল্পনায় ব্যস্ত। নতুন বন্দর নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। বড় ছেলের মতো যে প্রতিদিন আমাদের খাওয়াচ্ছে, তাকে পরিচর্যা না করায় সে রুগ্‌ণ হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কারও খেয়াল নেই।
ব্যবসায়ীরা বলেন, আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমি বলি, দেয়ালে ঠেকে নাই। সেই দেয়াল ভেঙে গেছে। কারণ বন্দর এখন ২৪, ৪৮, ৭২ ঘণ্টা হরতালের মতো ঘণ্টা বাড়িয়ে সেবা দেয় আমাদের।
কোরবানির ঈদের পর প্রতিদিন ১৫টি কনটেইনার জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর জন্য বহির্নোঙরে অপেক্ষায় থাকত। এত কিছু করার পর অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা ১৪টিতে নেমে এল। এই হলো বন্দরের অগ্রগতি। অর্থাৎ আগে ৩২ পেয়েছিলাম, এখন ১ পেয়ে ৩৩ পেলাম। ৩৩ পেয়ে পাস করলাম।
এখন বড় সম্ভাবনার কথা বলি। আমাদের একজন সাহসী প্রধানমন্ত্রী আছেন। পদ্মা সেতুর মতো কাজ ডিল করতে পেরেছেন। তাঁকে বোঝানো গেলে বন্দরের সমস্যা কেন সমাধান হবে না?
আমার প্রস্তাব হলো, নৌপরিবহন থেকে বাদ দিয়ে বন্দরের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় করতে হবে। রেলের জন্য পৃথক সড়ক ও সেতুর জন্য মন্ত্রণালয় হলে কেন বন্দরের জন্য নয়? শুধু বন্দর মন্ত্রণালয় করলে হবে না। ইদানীং তরুণ মন্ত্রীরা ভালো করছেন। তরুণ একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠানো হোক। বন্দর মন্ত্রণালয়ের সচিবালয় হবে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম থেকে পায়রা বন্দরের পরিচর্যা হবে। না হলে এসব চলতে থাকবে।

মু. রইচ উদ্দিন খান
মু. রইচ উদ্দিন খান

মু. রইচ উদ্দিন খান: কাস্টমস নিয়ে অনেকগুলো বিষয় এসেছে। প্রথমে স্ক্যানিং ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে চাই। স্ক্যানার আনা হয়েছে বাণিজ্য সহজীকরণের উদ্দেশ্যে। আইনে কিন্তু সব পণ্য পরীক্ষার বিধান আছে। বাস্তবে যেভাবে বাণিজ্য বেড়েছে তাতে সেটা সম্ভব নয়। বর্তমানে চারটি স্ক্যানার দিয়ে কনটেইনার না খুলে পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরিকল্পনা আছে বন্দরের ১২টি ফটকে স্ক্যানার স্থাপন করার। বাণিজ্য সহজীকরণ করতে এসব স্ক্যানারের সঙ্গে অনলাইনে আসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যার সংযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
বন্দরে পড়ে থাকা পণ্যের নিলাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার মতো নিলাম প্রক্রিয়া অনলাইন করা গেলে আরও গতি আসবে। তবে নিলামের বিধিবিধান মানতে হলে চাইলেই পণ্য বিক্রি করা যায় না। যেমন নিয়ম অনুযায়ী প্রথমবার নিলামে ওঠা কোনো পণ্যের সর্বোচ্চ দর কাস্টমসের সংরক্ষিত মূল্যের কম হলে বিক্রি করা যায় না। আবার একই পণ্য দ্বিতীয় নিলামে যে দর ওঠে, তা প্রথম নিলামের চেয়ে কম হলেও বিক্রি করা যায় না। নিলামে সর্বোচ্চ দরেও কেউ পণ্য পেলে যদি আমদানিকারক মামলা করেন, তাহলেও এই পণ্য বিক্রি করা যায় না। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়, যখন আমদানিকারক মামলা করার পর সর্বোচ্চ দরদাতাও যদি আইনের আশ্রয় নেন। তখন এই পণ্য বন্দর থেকে খালাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। এরপরও নিলাম প্রক্রিয়ায় যাতে গতিশীলতা আসে, সে জন্য এখন মাসে দুটি নিলাম হচ্ছে। বর্তমান বিধিবিধান পরিবর্তনেও আলোচনা হচ্ছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ নিলাম পণ্য রাখার নতুন শেড করেছে। বন্দরের মূল চত্বর থেকে নতুন একটি কনটেইনার রাখার ইয়ার্ডে বেশ কিছু কনটেইনার স্থানান্তর হয়েছে। এটা চলমান রাখা বন্দরের জন্য চ্যালেঞ্জ।
বন্দরের সঙ্গে কাস্টমসের কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি। অনেক সময় কাস্টমসের কার্যক্রম বন্দর থেকে পণ্য খালাসে গতি আনতে পারে। সেই চেষ্টা চলছেও। যেমন এক বছর আগে আমদানি চালানের ২৫ ভাগ বা তারও বেশি পণ্য চালান পরীক্ষা করা হতো। এই পরীক্ষার প্রক্রিয়া পণ্য খালাসের গতি ধীর করে দেয়। একটি কনটেইনার খুলে পরীক্ষা করা হলে তিন-চার দিন সময় লাগে। এতে খরচ বাড়ে। তবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সংস্কার করে পরীক্ষার হার ২৫ থেকে ১২ ভাগে আনা হয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে, এক-দুই মাসে তা ১০-এর নিচে নিয়ে আসা। আবার ঝুঁকিহীন প্রতিষ্ঠান বাছাই করে পরীক্ষা ছাড়াই পণ্য খালাসের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এটি করা গেলে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা পণ্যে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া যাবে। বন্দরে কনটেইনার খুলে পণ্য পরীক্ষার জন্য একটি আলাদা চত্বর বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলেছি আমরা। এটা হলে বন্দরের অভ্যন্তরেও জট কমে আসবে।

বাণিজ্য সহজীকরণ করতে এখন ‘সিঙ্গেল উইনডো’ নিয়ে কাজ হচ্ছে। পণ্য চালান খালাসের জন্য সবগুলো সংস্থাকে এক জায়গায় নিয়ে আসার এই প্রক্রিয়া চালু করা গেলে পণ্য খালাসে সময় অনেক কমে আসবে।

একটা কথা বলতে হয়, আমদানি-রপ্তানিকারকদের পণ্য খালাসে এগিয়ে আসতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখেছি, মেনিফেস্ট (আমদানির প্রাথমিক দলিল) জমা দেওয়া পণ্য চালান খালাসের প্রথম পদক্ষেপ। এরপর নিবন্ধন হয়। দেখা গেছে, প্রথম দিনে মাত্র ২০ শতাংশ চালানের ‘বিল অব এন্ট্রি’ জমা দেন আমদানিকারকেরা। তার মানে দিনে দিনে পণ্য খালাসের জন্য ২০ শতাংশ আমদানিকারক প্রস্তুত থাকেন। আর বন্দর চার দিন বিনা ভাড়ায় পণ্য রাখার সুযোগ দেয়। এই সময়ে বিল অব এন্ট্রি জমা হয় ৫০ শতাংশ। আর প্রথম ১০ দিনে জমা হয় ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২২ শতাংশ পণ্য চালান বন্দরে আসার ১০ দিন পরও আমদানিকারকেরা খালাসের জন্যই আসেন না। এটা বাড়ানো গেলে পণ্য খালাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এসব নিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে চট্টগ্রাম চেম্বার কাজ করতে পারে।

মাহবুবুল আলম
মাহবুবুল আলম

মাহবুবুল আলম: কিছুদিন আগে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে অনেক সমস্যার কথা উঠে এসেছে। বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে তখন। এতে কিছুটা স্বস্তিও আসে। এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যবসা বাড়ছে ১৩০ মাইল গতিতে। বন্দরের সক্ষমতা যদি ৬০ মাইল গতিতে বাড়ে, তাহলে সেবার মান কতটুকু বাড়বে? বন্দর আমার কাছ থেকে মাশুল নেবে, বিনিময়ে পণ্য পরিবহনের কাজটা দ্রুততার সঙ্গে করবে। এই সমঝোতার ভিত্তিতেই আমরা ব্যবসা করছি। এখন দেখা যাচ্ছে, বন্দরের এই অবস্থার কারণে জাহাজের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, নির্ধারিত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ করতে না পারায় বিমানে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। বন্দর সক্ষমতা একেবারেই বাড়েনি এ কথা বলা ঠিক নয়। তবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করেনি বলেই আজ এই অবস্থা।
গত ৪০ বছরে কয়টি জেটি নির্মাণের দরকার ছিল। কয়টি হয়েছে। নৌমন্ত্রীকেও বলেছি, জেটির দরকার ছিল ৬০টি। হয়েছে ৭টি। এর ফলে এখন যে বড় জাহাজে প্রতিদিন ১০ হাজার থেকে ১৪ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে, এই টাকা দিতে হতো না। এই টাকা বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা তো ভুক্তভোগী হচ্ছেন, তবে দিন শেষে ভোক্তাকেই এই টাকা দিতে হচ্ছে।
প্রথমেই প্রয়োজন ছিল জেটি করার, বন্দর করল কার শেড। গত ২ বছরে একটি টার্মিনালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, অর্থাৎ নৌমন্ত্রী চাইলে করতে পারেন। বন্দর চাইলে পারে। শুধু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এগুলো হচ্ছে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালে ৬০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছেন। কিন্তু ব্যবসা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেভাবে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ছে না। আমরা বে টার্মিনাল প্রকল্প ফাস্ট ট্র্যাকে আনার কথা বলেছি। এখনো ফাস্ট ট্র্যাকে আসেনি। বে টার্মিনালের ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র নিতে ১৮ মাস সময় চলে গেছে।

ব্যবসায়ীরা পদে পদে সমস্যা মোকাবিলা করছেন। বন্দরের পর্ষদে কোনো বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব নেই। সেখানে ফেডারেশনের প্রতিনিধি থাকলে নিজেদের কথা বলতে পারতেন ব্যবসায়ীরা।

গ্যান্ট্রি ক্রেন কেন কেনা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলা করতে পারলে বন্দরে কেন সামান্য ১০টি গ্যান্ট্রি ক্রেন কেনা যাবে না? গ্যান্ট্রি ক্রেন কিনলে অর্থনীতির লাভ হবে। এটা নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে চান না।

কর্ণফুলী খনন হচ্ছে না। কর্ণফুলী না থাকলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। কর্ণফুলীর আশপাশে ভরাট হয়ে গেছে। মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলী না বাঁচলে বন্দর বাঁচবে না। বন্দর না বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে না।

আরেকটি কথা, বন্দরের আবাসিক এলাকায় এক বিঘা, দুই বিঘা, এক একর জায়গার ওপর একেকটা বাংলো গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কেন কনটেইনার টার্মিনাল করতে পারি না? বহুতল ভবন করেও কর্মকর্তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা যায়। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী যদি ফ্ল্যাটে থাকতে পারেন, এখানে কর্মকর্তারা কেন পারবেন না?

বন্দর দিয়ে নতুন নতুন পণ্য আমদানি হচ্ছে। কয়লা, পাথর, স্ক্র্যাপ নতুন আসছে। এগুলো খালাস করার জন্য নতুন ঘাট নেই। এখন থেকে আগামী ৫০ বছরে বন্দরে কী কী অবকাঠামো লাগবে, তা নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। এখন থেকে কাজ শুরু না করলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অনুলিখন: মাসুদ মিলাদ সুজন ঘোষ

যাঁরা অংশ নিলেন

মুহাম্মদ সিকান্দার খান      :   উপাচার্য, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি

হাদী হোসাইন               :   সাবেক পর্ষদ সদস্য (পরিকল্পনা), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

এস এম আবু তৈয়ব        :   সভাপতি, আইবিএফবি (ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ), চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার

আহসানুল হক চৌধুরী      :   সভাপতি, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন

নাসির উদ্দিন চৌধুরী        :   চেয়ারম্যান, পোর্ট অ্যান্ড শিপিং স্ট্যান্ডিং কমিটি, বিজিএমইএ

মাহবুবুল আলম             :   সভাপতি, চট্টগ্রাম চেম্বার

মু. রইচ উদ্দিন খান          :   যুগ্ম কমিশনার, চট্টগ্রাম কাস্টমস

খায়রুল আলম সুজন       :   পরিচালক, বাফা

আবুল বশর চৌধুরী         :   পরিচালক, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার

নাসরিন সরোয়ার           :   উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী

রোজিনা আক্তার            :   পরিচালক, চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার

খন্দকার লতিফুর রহমান   :   আহ্বায়ক, কাস্টমস, বন্দর ও জাহাজীকরণবিষয়ক কমিটি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)

সঞ্চালক

বিশ্বজিৎ চৌধুরী             :   যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

স্বাগত বক্তব্য

লাজ্জাত এনাব মহছি        :   উপসম্পাদক, প্রথম আলো