মৃত গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু - ময়নাতদন্ত

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

বাংলাদেশের সমুদ্রবক্ষে একমাত্র উৎপাদনশীল গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু আনুষ্ঠানিকভাবে নিঃশেষ ও পরিত্যক্ত হয় ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। প্রদীপের আলো যেমন কখনো বা সহসা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে নিভে যায়, সমগ্র চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস সরবরাহের প্রধান উৎস সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রটি হঠাৎ দুর্বল হয়ে কয়েক বছরের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। চট্টগ্রামকে গ্যাস-সংকটের সাগরে ভাসিয়ে ও সারা দেশের গ্যাস-সংকটকে আরও প্রকট করে তুলে মাত্র ১১ বছর বয়সে সাঙ্গুর এই প্রস্থান যেন গ্যাসক্ষেত্রটির অপ্রত্যাশিত মৃত্যু। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, সাঙ্গুর কি স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে, নাকি সাঙ্গু অপমৃত্যুর শিকার। কী হয়েছিল সাঙ্গুর? কেমনই বা ছিল এ গ্যাসক্ষেত্রটির মজুত ও উৎপাদন ধারা বা তার ভূতাত্ত্বিক প্রকৃতি? গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণে বা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে সাঙ্গু কি আমাদের কোনো দিকনির্দেশনা দেয়?
সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রটি ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ তেল কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি কর্তৃক আবিষ্কৃত হয় এবং কোম্পানিটি ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু করে। এ সময় স্বভাবতই বাংলাদেশের গ্যাস কার্যক্রমে এক নতুন আশার সঞ্চার হয়। অনেকে আশা করলেন যে পৃথিবীর অনেক দেশে যেমন সাগরবক্ষে তেল-গ্যাসের বিরাট আধার উন্মোচন তাদের অর্থনীতিকে বিপুলভাবে চাঙা করেছে, বাংলাদেশও বুঝি তার সাগরবক্ষের গ্যাস সম্পদকে অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে উন্মোচিত করতে পেরেছে। দৈনিক প্রায় ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন মাত্রায় শুরু হওয়া সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কয়েক বছরের মধ্যে দৈনিক ১৪০ থেকে ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট বা তার বেশি মাত্রায় গিয়ে পৌঁছে। সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে এক টিসিএফ গ্যাস আছে ধারণা দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে তার মজুত প্রায় অর্ধেক বা ৫৮০ বিলিয়ন ঘনফুট নির্ধারণ করা হয়।
আশাহতের বিষয় এই যে ২০০৭-০৮ সালে অর্থাৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার মাত্র নয় বছরের মধ্যেই হঠাৎ সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদনে ধস নামে। উৎপাদনমাত্রা ২০০৯ সালে গড়ে দৈনিক ৪৯ মিলিয়ন ও ২০১১ সালে গড়ে দৈনিক ১৮ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে গেলে গ্যাসক্ষেত্রটি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। এর আগে গ্যাসক্ষেত্রটি পরিচালনাকারী বিদেশি কোম্পানি এটিকে উজ্জীবিত করার জন্য সেখানে কম্প্রেসর স্থাপন করে ও ২০০৯ সালে তিনটি নতুন কূপ খনন করার কাজ হাতে নেয়। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা গ্যাসক্ষেত্রটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হয়। ২০১৩ সালের শেষের দিকে গ্যাসক্ষেত্রটির উৎপাদন দৈনিক দুই থেকে তিন মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এলে এটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা
করা হয়। কোম্পানির ভাষ্যমতে, সাগরে উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রে প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন না করলে তা লাভজনক হয় না।
স্বাভাবিক মৃত্যু না অপমৃত্যু: সাঙ্গু নিয়ে একটি বিতর্ক থেকে যায়। দেশীয় বিশেষজ্ঞ মহলে অনেকে এ মত প্রকাশ করেন যে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রটি হঠাৎ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হলো, গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে একপর্যায়ে অতি দ্রুত উৎপাদন করা। তাঁদের মতে, কূপপ্রতি যে পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করা সংগত, তার চেয়ে অধিক গ্যাস উৎপাদন করার ফলে ভূ-অভ্যন্তরে গ্যাসস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার পরিণতিতে গ্যাসক্ষেত্রটির অপমৃত্যু ঘটে। বিদেশি কোম্পানি তার লাভ দ্রুততর সময়ে উঠিয়ে নিতে অতি দ্রুত গ্যাস ওঠানোর ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী হয়ে থাকে। দেশের গ্যাস-সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে কোম্পানিকে অধিক উৎপাদনের দেশীয় পরামর্শ তাকে এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী করে তুলতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্যাসক্ষেত্রের সুস্থ ভবিষ্যৎ নিয়ে বিদেশি কোম্পানির কোনো মাথাব্যথা থাকে না।
ওদিকে সাঙ্গু পরিচালনাকারী কোম্পানির (আগে ব্রিটেনের কেয়ার্ন এনার্জি ও শেল অয়েল কোম্পানি ও পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস লিমিটেড) কর্মকর্তারা ভিন্নতর মত পোষণ করেন। বিষয়টি সম্পর্কে সান্তোস কোম্পানির ভূবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশপ্রধান (ভূতপূর্ব) ড. জন চেম্বার মনে করেন যে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রটি অপ্রত্যাশিতভাবে নিঃশেষ হওয়ার পেছনে দ্রুত উৎপাদনের প্রভাব রয়েছে, এ ধারণাটি সঠিক নয়। তাঁর মতে, প্রকৃতপক্ষে সাঙ্গুর গ্যাসস্তরের ভূতাত্ত্বিক প্রকৃতিই এর জন্য দায়ী। কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসস্তরগুলো যেমন বড় এলাকাজুড়ে সুসমভাবে বিস্তৃত থাকে, সাঙ্গুর ক্ষেত্রে তা লক্ষ করা যায় না, বরং এ ক্ষেত্রে গ্যাসস্তরগুলো সীমিত আকারে অসমভাবে বিস্তৃত। সাঙ্গুতে প্রায়ই গ্যাসস্তরগুলো কাদাশিলা (চ্যানেল ফিল) দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যা তার বিস্তৃতিকে আকস্মিকভাবে থামিয়ে দিয়েছে।
সাঙ্গু থেকে আমরা কী পেলাম: পেট্রোবাংলার এমআইএস রিপোর্ট সূত্রে জানা যায় যে ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রায় ৪৮৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে খরচ উশুল (কস্ট রিকভারি) এবং প্রফিট গ্যাস হিসেবে বিদেশি কোম্পানি ভাগ নেয় প্রায় ৩৬১ বিলিয়ন ঘনফুট, যা কিনা কোম্পানি পেট্রোবাংলার কাছে প্রতি ইউনিট তিন ডলারে বিক্রি করে। অর্থাৎ মোট উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ৭৪ শতাংশ অংশ পায় বিদেশি কোম্পানি আর ২৬ শতাংশ পায় বাংলাদেশ। বিদেশি কোম্পানির ভাগের অংশে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও উৎপাদন করা বাবদ খরচ হওয়া অংশটুকুও অন্তর্ভুক্ত, যা কিনা বাংলাদেশ নিজে করলেও তাকে তা বহন করতে হতো। তবে এখানেই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস ভাগাভাগির প্রশ্নে একটি বিতর্ক থেকে যায়। বিদেশি কোম্পানি তার খরচের যে হিসাব পেট্রোবাংলার কাছে দাখিল করে, প্রকৃত খরচের চেয়ে তা বেশি বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে (কথিত আছে, কোম্পানির কর্মকর্তারা তাঁদের গৃহের পোষা বিড়ালকে গোসল করানোর জন্য ব্যবহূত শ্যাম্পু ওই খরচের খাতায় অন্তর্ভুক্ত করেন!)। আর এ ক্ষেত্রে প্রকৃত খরচ যাচাই-বাছাই করার জন্য সুদক্ষ কর্মীর অভাব বাংলাদেশকে দুর্বল অবস্থানে রেখে দেয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অযাচিত খরচের নমুনা স্পষ্ট যেমন সাঙ্গু গ্যাস উত্তোলনের পর তা প্রসেসিংয়ের জন্য চট্টগ্রামের সিলিমপুরে নির্মিত গ্যাস প্রসেসিং প্ল্যান্টটির ক্ষমতা প্রতিদিন ৫২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, যা কিনা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এটি বর্তমানে কেবলই একটি সাদা হাতি, যার বিশাল নির্মাণ খরচটি ‘খরচ উশুল’ হিসাবে কোম্পানির গ্যাসের ভাগে যুক্ত হয়েছে।
উপসংহার: বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় আজ অবধি ১৯টি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন হয়েছে এবং এর ফলে দুটি আবিষ্কার ঘটে। এগুলোর মধ্যে কেবল সাঙ্গু ক্ষেত্রটি গ্যাস উৎপাদনশীল ছিল। সাগরবক্ষে আবিষ্কৃত অন্য গ্যাসক্ষেত্র কুতুবদিয়া অল্প মজুত ধারণ করে বলে তা উৎপাদনে আনা হয়নি। ভূবিজ্ঞানীদের ধারণা, বাংলাদেশের সাগরবক্ষে মূল ভূখণ্ডের মতো অতি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর আকারের গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে গ্যাসক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থাকে বিবেচনায় এনে কূপপ্রতি গ্যাস উৎপাদন হার বা মাত্রা সংযত রাখা বাঞ্ছনীয়।
দেশের মূল ভূখণ্ডে হবিগঞ্জ জেলায় বিদেশি কোম্পানি শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ করে। এ গ্যাসক্ষেত্রে কূপপ্রতি গ্যাস উৎপাদন অন্য কোনো গ্যাসক্ষেত্রের তুলনায় অনেক বেশি। সম্প্রতি শেভরন দেশীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাস উৎপাদন আরও বৃদ্ধির বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশ গ্যাস সরবরাহের জন্য শেভরনের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং এ নির্ভরশীলতা ভবিষ্যতে বাড়বে বৈ কমবে না। তিতাসের পর বিবিয়ানাই বাংলাদেশে সুবিশাল গ্যাসক্ষেত্র, যা দেশের গ্যাস সরবরাহে রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সাঙ্গুর অভিজ্ঞতা থেকে এটি ধরা যায় যে উৎপাদন কূপের ক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন বাড়ালে গ্যাসক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ক্ষতি হতে পারে, যা কিনা গ্যাসক্ষেত্রটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রশ্ন ওঠে যে বিবিয়ানার কূপগুলোয় কি মাত্রাতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করা হয়? পেট্রোবাংলা প্রদত্ত তথ্যমতে, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে বর্তমানে উৎপাদনরত ১৪টি কূপের উৎপাদনক্ষমতা প্রতিদিন ৭৭০ মিলিয়ন ঘনফুট, কিন্তু উৎপাদন করা হয় ৮১০ মিলিয়ন ঘনফুট (পেট্রোবাংলা ওয়েবসাইট, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৪)।
বিদেশি কোম্পানি সব সময়ই অতি দ্রুত উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে থাকে, কারণ তাতে তাদের লাভও হয় দ্রুত হারে। এতে ভবিষ্যতে গ্যাসক্ষেত্রের ভালো কি মন্দ হবে, তা নিয়ে বিদেশিদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। দেশের গ্যাস-সংকট মেটানোর জন্য বিদেশি কোম্পানিকে দ্রুত ও
অধিক মাত্রায় উৎপাদনের পরামর্শ দেওয়ার আগে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলোর সুস্বাস্থ্য বিবেচনায় রেখে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়াটা অধিকতর যুক্তিসংগত।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।