পাকিস্তানি সেনাদের চুরিচামারি, তেজারতি

আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি ,রাও ফরমান আলী
আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি ,রাও ফরমান আলী

ইয়াহিয়া খান, আবদুল হামিদ খান, আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি। এই ত্রয়ী যেন যোগ্য গুরুর যোগ্য শিষ্য। ইয়াহিয়া খানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গতকালের কিস্তিতে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর অনেক নৈশ অভিযানে অনুগামী হতেন আবদুল হামিদ খান। রাওয়ালপিন্ডির হেজারলি স্ট্রিটে ইয়াহিয়ার বাড়িতে মেয়েবন্ধুদের নিয়ে তাঁরা দুজনই রাত কাটাতেন।

আর নিয়াজির দুষ্কর্মের খতিয়ান মিলেছে ঢাকায় পদায়িত হওয়ার অনেক আগে থেকে। দুই বেসামরিক সাক্ষী আবদুল কাইয়ুম আরিফ ও মুনওয়ার হোসেন হামুদুর রহমান কমিশনকে জানান:
শিয়ালকোটের জিওসি এবং পরে লাহোরের সামরিক আইন প্রশাসক পদে থাকাকালে জেনারেল নিয়াজি চোরাচালানি ও অন্যান্য অপরাধের মামলা নিষ্পত্তির নামে লাখ লাখ রুপি (টাকা) কামিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি লাহোরের গুলবার্গের সাইদা বুখারি নামের এক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সাইদা সিনোরিটা নামের একটি পতিতালয় পরিচালনা করতেন। সাইদা জেনারেলের পক্ষে ঘুষের অর্থ ও মালামাল গ্রহণ করতেন। ওই দুই সাক্ষী শিয়ালকোটে শামীম ফেরদৌস নামের আরেক নারীর কথা বলেছেন, যিনি সাইদা বুখারির ভূমিকা পালন করতেন। নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হয়ে গেলে সাইদা বুখারিও সেখানে যান এবং তাঁকে (নিয়াজি) ব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে পান আমদানি করতেন। সামরিক আদালতের মামলায় গৃহীত উৎকোচ ওই দুই সাক্ষীর মাধ্যমে নিয়াজি গ্রহণ করতেন বলে তাঁরা কমিশনকে জানিয়েছেন। গোয়েন্দা ব্যুরো প্রাথমিক তদন্তে বলেছে, অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন নয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী আবদুল হাফিজ কারদার বলেছেন, জেনারেল নিয়াজি রাতের সময়টি আমোদ-ফুর্তিতে কাটাতেন। জুনিয়র কর্মকর্তারা যেসব জায়গায় আমোদ-ফুর্তি করতেন, তিনিও সেখানে যেতেন। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হতো যে মুসলিম দেশের প্রতিনিধি হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা অনৈতিক কাজে নিয়োজিত থাকতেন। ফলে বৈরী প্রতিবেশী দেশটি এই প্রচার চালাত যে ধর্ম এদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। নিয়াজির অপকর্মের কারণে প্রচারযুদ্ধে আমরা আগেই হেরে গেছি।
কারদারের ভাষ্য অনুযায়ী, নিয়াজি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার কিছু বাংলোতে যেতেন। পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্বরত কিছু জুনিয়র অফিসার তাঁকে এ তথ্য দিয়েছেন।
মেজর সাজ্জাদুল হক নামের জুনিয়র এক অফিসার জানান, জেনারেলের বিনোদনের জন্য রোজার দিনেও নাচের মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হতো। আর এসব মেয়েকে আনা-নেওয়া করত তিন তারকাযুক্ত সরকারি পতাকাবাহী গাড়ি। এটি ছিল তাঁর মানসিক বৈকল্য।
বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা সি এ ওয়াহিদ সাক্ষ্য দিয়েছেন, নিয়াজির সামাজিক জীবন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও জওয়ানরা সবাই জানতেন। এটি সবখানে আলোচনা হতো। লে. কর্নেল হাফিজ আহমেদের ভাষ্য, নিয়াজি পশ্চিম পাকিস্তানে পান রপ্তানির ব্যবসা করতেন।
মেজর জেনারেল জাহানজেব ও ব্রিগেডিয়ার হায়াতুল্লাহর বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাহানজেব যখন মুলতানে সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন, একজন পিসিএস (পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন) কর্মকর্তার কাছে এক লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। এরপর ওই পিসিএস কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে তিনি আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে তিনি এক চিরকুটে লিখে রাখেন, তিনি ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। অথচ সামরিক আইন প্রশাসককে দিতে হবে এক লাখ টাকা। ব্রিগেডিয়ার হায়াতুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ, পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ চলাকালে ১১ ও ১২ ডিসেম্বর তিনি তাঁর বাংকারে কয়েকজন নারীকে নিয়ে যান বিনোদনের জন্য।
কমিশন বলেছে, যেসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিজেদের পদমর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন এবং পেশাদারি চেতনা ও দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, নৈতিক অবক্ষয় ঘটিয়েছেন, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত।
নিয়াজির পানের ব্যবসা সম্পর্কে আরও কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। রাও ফরমান আলীর দাবি, তিনি এই ব্যবসায় সহায়তা করেননি বলে নিয়াজি তাঁর ওপর কোপিত ছিলেন। এ ব্যাপারে পিআইএর কর্মকর্তা হামিদুদ্দিনের কাছে তদবির করা হলে তিনি নিয়াজির এডিসিকে জানিয়ে দেন, পান রপ্তানি পুরোপুরি বাণিজ্যিক বিষয়। পিআইএ ও রপ্তানিকারকের মধ্যে চুক্তি হতে হবে।
কর্নেল বশির আহমেদ খানের সাক্ষ্যমতে, মেজর জেনারেল জামশেদ খানের স্ত্রী ১৬ ডিসেম্বর সকালে ঢাকা ত্যাগের সময় কিছু টাকাপয়সা নিয়ে গেছেন। জামশেদ অবৈধ উপায়ে ওই অর্থ উপার্জন করেছেন এবং যাঁরা ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা ত্যাগ করেছেন, তাঁদের হাতে কিছু টাকা বিতরণ করেছেন।
কমিশনের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে জামশেদ বলেছেন, মোট টাকার পরিমাণ ৫০ হাজার। এটি ছিল বিশেষ তহবিল এবং তথ্য সংগ্রহের কাজে তা ব্যয় করা হতো। কাকে এই অর্থ দেওয়া হবে, তা ছিল সম্পূর্ণ তাঁর এখতিয়ার। কমিশন তাঁর জবাবে সন্তুষ্ট হয়নি।
মেজর জেনারেল নজর হুসেইন শাহ, মেজর জেনারেল আনসারী ও ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক ছয়জন সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে কমিশনকে জানিয়েছেন, এই কর্মকর্তারাও তাঁদের ইউনিটে ব্যাপক লুটপাটে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ ন্যাশনাল ব্যাংক মালখানার ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা লুট। একটি ট্রাকে লুকিয়ে যখন এই টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন পাকশী সেতুতে সেটি আটকে দেওয়া হয়।
অবৈধ ব্যবসা ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগ ছিল রাও ফরমান আলীর বিরুদ্ধেও। নিয়াজির দাবি, ১৬ ডিসেম্বর সকালে ভাতিজার মাধ্যমে তিনি আনুমানিক ৬০ হাজার টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছেন বিমানের পাইলটের সহায়তায়। ফরমান আলী বলেছেন, ওই অর্থ প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরকে দিয়েছিলেন জরুরি খরচ চালানোর জন্য। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর এম এ মালেক পদত্যাগ করায় অর্থ তাঁর কাছেই ছিল। মেজর জেনারেল রহিম খানকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার পর বাকি টাকা মেজর আলী জাওহারের হাতে দেন এবং তা সরকারি কোষাগারে জমাও দেওয়া হয়েছে। নিয়াজির জবাবে কমিশন সন্তুষ্ট না হলেও রাও ফরমান আলীর জবাব তারা গ্রহণ করেছে।
হামুদুর রহমান কমিশনের পর্যবেক্ষণ হলো, লে. জেনারেল নিয়াজি যেদিন ঘোষণা করলেন, শত্রুরা তাঁর লাশের ওপর দিয়ে ঢাকায় ঢুকবে; পরদিন দেশবাসী বোকা বনে গেল বিদেশি গণমাধ্যমে তাঁর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের খবর শুনে। ১৬ ডিসেম্বর রমনার রেসকোর্সে তিনি অস্ত্র সমর্পণের পর ৯৩ হাজার জওয়ান ও অফিসারও আত্মসমর্পণ করেন। সেদিন বিকেলেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বার্তায় বললেন, জাতি কোনো একটি ফ্রন্টে পরাজিত হলেও পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কিন্তু পরদিন জাতি পুনরায় শুনল যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তিনি মেনে নিয়েছেন। এই ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং যারা দেশকে অসম্মানিত ও ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছে, প্রকাশ্য আদালতে তাদের বিচার চেয়েছে।
আগামীকাল: বিদ্রোহ দমনের নামে নৃশংসতা
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]