রামাফোসার হাতে অনেক কাজ

সিরিল রামাফোসা। ছবি: রয়টার্স
সিরিল রামাফোসা। ছবি: রয়টার্স

দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সিরিল রামাফোসাকে নেতা নির্বাচিত করে পৃথিবীর প্রতি আনুকূল্য দেখিয়েছে। এখন দেশটিকে দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে দলটির হাতে সত্যিকার অর্থেই সুযোগ এসেছে। আর বর্ণবাদের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যাপারটা তো আছেই। রামাফোসা এখন নিশ্চিতভাবেই ২০১৯ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার নেতৃত্বে দেশটির ব্যর্থতা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সরকারি বিভিন্ন ঠিকা দলবাজদের দেওয়া হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা সরকারি পদ-পদবি নিয়ে মারামারি করতে গিয়ে পরস্পরকে খুন করছেন। অসৎ মানুষ ক্রমে বিচারের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

যাহোক, দলীয় নির্বাচনে রামাফোসা জ্যাকব জুমার সাবেক স্ত্রী এনকোসাজানা দামিনি-জুমাকে পরাজিত করেন। এএনসির সাবেক মন্ত্রী হিসেবে দামিনি জুমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও কম নয়। কিন্তু তাঁর প্রধান যোগ্যতা ছিল আনুগত্য। তিনি জিতলে তাঁর সাবেক স্বামীকে ৭৮৩টি দুর্নীতি মামলা থেকে আগলে রাখবেন-এমন প্রত্যাশা ছিল। তিনি বিজয়ী হলে দক্ষিণ আফ্রিকা এক বংশানুক্রমিক চৌর্যবৃত্তির দেশে পরিণত হতো।

এর বিপরীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২৫ বছর আগে যে আশাবাদের বিচ্ছুরণ দেখা গিয়েছিল, রামাফোসার বিজয় তা পুনরুদ্ধারের শ্রেষ্ঠ উপায়। ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা যখন কারাগার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, তখন তরুণ আইনজীবী হিসেবে রামাফোসা তাঁর পাশেই ছিলেন। তাঁকে পরবর্তী নেতৃত্ব হিসেবেই তৈরি করা হচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে থাবো এমবেকি ম্যান্ডেলার উত্তরসূরি নির্বাচিত হলে তিনি আর নেতৃত্বে আসীন হতে পারেননি। এরপর তিনি রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসায় যোগ দেন। সাবেক এই ট্রেড ইউনিয়ন নেতা দেশের অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। আর তিনি এখন দেশটির পুঁজিবাদী মহলের গ্রহণযোগ্য মানুষদের একজন। একই সঙ্গে দেশটির ক্ষুদ্র, কালো অভিজাত গোষ্ঠী ও বিপুল দরিদ্র কালোদের মধ্যে যে ব্যবধান বাড়ছে, তিনি সেই ক্রমবর্ধমান ব্যবধানেরও প্রতিনিধি। দক্ষিণ আফ্রিকা পৃথিবীর অন্যতম অসম দেশ। আর এই চরম অসমতার কারণ হচ্ছে এক উৎকট বর্ণবাদী শাসন।
১৯৯৪ সালে প্রাতিষ্ঠানিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটার পর দেশটিতে অসমতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশটির দরিদ্রতম মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্ণবাদী শাসনের রেশ মোকাবিলার চেষ্টা করা হলেও তা এখনো আয়, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সম্পদবৈষম্যের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। দক্ষিণ আফ্রিকার শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর বেশির ভাগই শ্বেতাঙ্গ। জাতীয় আয়ের ৬০ শতাংশ এদের পকেটে যায়। এদের আয় ইউরোপীয়দের মতো। আর নিচের সারির ৯০ শতাংশ মানুষ আফ্রিকার সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের মতো জীবন যাপন করে, যাদের প্রায় সবাই কালো।

দেশটির অর্থনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকায় রামাফোসা জানেন, ১৯৯০-এর দশকের বাণিজ্য উদারীকরণের কারণে দেশটির সবচেয়ে ধনী লোকজন সম্পদ বানাতে পেরেছে। আর সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষ অনাবৃত হয়ে পড়ে। তাঁর যেমন খনিশ্রমিকদের ইউনিয়ন চালানোর অভিজ্ঞতা আছে, তেমনি খনি চালানোরও অভিজ্ঞতা আছে। তিনি জানেন, বৈশ্বিক পণ্যসম্ভারের ঘাড়ে চেপে যে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, তাতে কর্মসংস্থান হয়নি, এক দশক পর এটা প্রমাণিত হয়েছে।

দেশটিতে এখন বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশের ওপরে। সেখানে এখন প্রতি দুজন তরুণের একজন বেকার। সামাজিক ঐকতান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে রামাফোসা যদি পুনর্বণ্টন নীতি গ্রহণ করেন, তাহলে কারও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি হয়তো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা ঘোরাতে এবং চাকরি ও স্কুলে ভর্তির হার বাড়াতে এসব করবেন। আর দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম অর্থনীতি। দেশটিকে তার নৈতিক কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে হবে; জন্মের সময় এই তারা যা অর্জন করেছিল। কিন্তু বর্তমানের সস্তা রাজনীতির কারণে তারা সেটা হারিয়ে ফেলেছে।

দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ডান ও বাম দুই ধারার মধ্য দিয়ে রামাফোসাকে অগ্রসর হতে হবে। ডান দিকে দেখা যাচ্ছে যে গণতান্ত্রিক জোট শক্তিশালী হচ্ছে, যারা দেশটির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর শাসন করছে। আর বাম দিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাযোদ্ধাদের জনতুষ্টিবাদী কোলাহল শোনা যাচ্ছে। আবার দলের মধ্যে আঞ্চলিক হোতাদের সামলাতে হবে তাঁকে। এঁরা তো আর তাঁর মতো নন, কারণ; এঁরা ক্ষমতায় এসেছেন পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতিতে ভর করে। আর রাজনৈতিক বিতর্কের জন্য তো রাজনৈতিক দর্শন প্রয়োজন।

এএনসির মূল সমস্যা হচ্ছে প্রথমত একটি বৃহৎ রাজনৈতিক আন্দোলন হলেও পরবর্তী সময়ে তারা সমন্বিত আদর্শিক ভিত্তি তৈরি না করে রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। এটা ঠিক করতেই রামাফোসার পথপ্রদর্শক ম্যান্ডেলা রাজনীতি ত্যাগ করেছিলেন, তাই তাঁর সামনে এখন সেটা করার সেরা সুযোগ।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।