জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন, তার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর কারণে পাকিস্তান ভেঙে যায়। কিন্তু তাঁর নিন্দুকেরা এই তুলনাকে কল্পনাপ্রসূত ও সুদূরপ্রসারী আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান যে বিপজ্জনক অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা যৌক্তিকভাবে ও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হলে বোঝা যাবে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর। তখন এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকবে না।

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লাহোরের ছাত্ররা ছোট একটি জনসভার আয়োজন করেছিলেন। গণমানুষের কবি হাবিব জিলাব এবং বিশিষ্ট বাম নেতা বেগম তাহিরা মাজহার আলী খান ছাড়া আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা ওই সমাবেশে বক্তৃতা করেন। সেই ছাত্রনেতাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। গণমাধ্যমে আমাদের সমাবেশের খবর আসেনি। পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে। এরপর দেখা গেল, ‘দেশপ্রেমিক’ রাজনৈতিক দলগুলো সামরিক অভিযানের সমর্থনে মিছিল শুরু করল। বাকিটা ইতিহাস। এরপর দ্রুত সাম্প্রতিক কালে চলে আসি, তারপর পাঞ্জাবি ভোটারদের রায় কীভাবে পাঞ্জাব প্রভাবিত নিরাপত্তা বাহিনী অস্বীকার করল, সে প্রসঙ্গে আসি। জনসংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের ছোট প্রদেশ যেমন পাখতুনখাওয়া, বেলুচিস্তান ও সিন্ধের জনগণের রায় বেশ কয়েকবার লঙ্ঘন করা হয়েছে, যার কোনো বিচার হয়নি। শুধু তা-ই নয়, এখানকার মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যখনই আন্দোলন হয়েছে, তখনই তার ওপর চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নেমে এসেছে। এমনকি সামরিক অভিযানও চালানো হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর এই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত ক্ষমতাসীন সরকারকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল। প্রকৃত শাসকেরা রাজনৈতিক কারসাজির সব কৌশল ব্যবহার এবং গোয়েন্দাদের দিয়ে বল প্রয়োগ করিয়ে পাঞ্জাবের জনপ্রিয় নেতৃত্ব ধ্বংস করে দিতে চায়।

তবে সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার হলো, পাঞ্জাবের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা নওয়াজ শরিফ সব রকম চাপের মুখেও নতি স্বীকার করেননি। বড় বড় গণমাধ্যম বেসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকাঠামোর ভাষ্য প্রচার করে যাচ্ছে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে মানুষ সত্যটা জানতে পারছে। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বা অন্যান্য ছোট প্রদেশে জেনারেলরা যে ‘গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসার’ কৌশল ব্যবহার করেছিলেন, তা পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে কাজে আসবে না। কারণটা হলো, সামরিক ও আমলাতন্ত্রের সিংহভাগ অভিজাত লোক এই প্রদেশের। কিন্তু এই দ্বিচারণে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তবে দুই পরিস্থিতির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য আছে, আর তা হলো আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা। ১৯৭১ সালের তৎকালীন সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের জনতার ওপর নির্মম সামরিক নিপীড়ন চালিয়ে নিজেদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। ওই দলটি জান্তার সুনজরে ছিল না, তাই মানুষের ওপর এমন নির্যাতন চালায় তারা। এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো বুদ্ধিমান ও উজ্জ্বল পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিচ্ছিন্নতার অর্গল ভাঙতে পারেননি। আর আজকের পাকিস্তান ধর্মীয় চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের কারণে মারাত্মকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ভীতিকর ব্যাপার হলো, বেসামরিক সরকার যত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, ততই দেশটিতে চরমপন্থী ও জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে।

যাহোক, খাইবার পাখতুনখাওয়ার মুখ্যমন্ত্রী পারভেজ খটক প্রকাশ্যে ধর্মীয় চরমপন্থীদের জোট ডিফেন্স অব পাকিস্তান কাউন্সিলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে আফগানিস্তানে ‘জিহাদের’ প্রতি সমর্থন এবং দেশটিতে শরিয়াহ আইন আরোপ করা। প্রতীকীভাবে আফগান সীমান্ত লাগোয়া একটি প্রদেশকে তালেবানদের হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ হলো আফগানিস্তানে তালেবানদের যুদ্ধে সায় দেওয়া। কম করে বললেও, এই নীতি আত্মঘাতী হবে। এই নীতি কে প্রণয়ন করেছে এবং তার পরিণতি কে ভোগ করবে? আফগান প্রসঙ্গে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেন চোখে চোখ রেখে লড়াই করছে।

আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল খুররম এজেন্সিতে ড্রোন হামলার খবর মূলধারার গণমাধ্যমে আসেনি। কিন্তু পাকিস্তানের সেরা বন্ধুদের কাছেও তার এই চরমপন্থার প্রতি হৃদয়ে ভালোবাসার জায়গা থাকাটা হতাশাজনক। ২০১৭ সালের ব্রিকস সামিটের ঘোষণা যদি মাথায় রাখি, তাহলে বলতে হয়, চীনের মতো ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর পক্ষেও পাকিস্তানের এই রোমাঞ্চকর নীতি হজম করা কঠিন।

সাধারণ নির্বাচনে কয়েক মাস আগে বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক কারসাজির কারণেও বিপর্যয় ঘটতে পারে। বেলুচিস্তান দীর্ঘতম জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ মোকাবিলা করছে। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ায় সৌদি আরব ও ইরানের দ্বন্দ্বের কারণে এই প্রদেশ হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব বেলুচিস্তানে ওয়াহাবি ও সালাফি মতবাদের প্রসার ঘটাতে টাকা দিচ্ছে। জমাতুদ দাওয়া (জেইউডি) ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এটাও পরিষ্কার যে ইরান চুপচাপ বসে থাকবে না। শত্রুর শত্রুকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে ইরান খুবই প্রায়োগিক। তারা কট্টরপন্থী সুন্নি আল-কায়েদা ও তালেবানদের সমর্থন করতে পিছপা হয়নি, যদিও এরা একসময় তাদের শত্রু ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা এদের সমর্থন দিয়েছে। ফলে এখন যদি তারা সৌদিদের বিরোধিতায় বেলুচ জনগণকে টাকা দেয়, তাহলে কে তাদের ঠেকাবে?

এখন বেলুচিস্তানে স্থিতিশীলতা দরকার। ফেডারেশনের মধ্যে পিএমএল-এনকে ঠেকানোর জন্য বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক সরকারকে বেছে নেওয়া হয়েছে। জানুয়ারির মধ্যে বেলুচিস্তান, পাখতুনখাওয়া ও সিন্ধের প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেওয়া হলে এবং সেই সঙ্গে পাঞ্জাবে বিক্ষোভ হলে এবং সংসদের বিরোধীরা বিক্ষোভ করলে তা হবে চলমান অচলাবস্থা অকালে গুটিয়ে ফেলার উপায়।

সমালোচকদের তুলে নিয়ে ভিন্নমত দমন করা হলে সমস্যার সমাধান হবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলতে দিয়ে ঘর ঠিক রাখা হলে এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসপন্থার মূলোৎপাটনে এনএপি বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে একমাত্র সমাধান। আমরা সবাই জানি, যারা ইতিহাস থেকে শেখে না, তারা এর পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য নেশন ডট কম থেকে নেওয়া।

আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাজনীতি বিশ্লেষক।