ঢাকার নির্বাচন স্থগিতের সব দায় ইসির?

সাংবাদিক সোহরাব হাসান তাঁর ‘এই নির্বাচন কমিশন লইয়া কী করিব?’ শিরোনামে সম্প্রতি প্রথম আলোতে (২০ জানুয়ারি ২০১৮) প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কাউন্সিলর পদে নির্বাচন আদালত কর্তৃক স্থগিত করার পেছনে নির্বাচন কমিশনকে মূল ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মিজানুর রহমান খানও এ ব্যাপারে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন (প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারি ২০১৮)। তবে ডিসিসির নির্বাচন স্থগিতের পেছনে কমিশনই কি একমাত্র ভিলেন? আদালতের স্থগিতাদেশ প্রদানের পূর্ববর্তী ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২৮ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তথা সরকার গেজেটের মাধ্যমে কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদকে বিলুপ্ত করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৮টি করে ৩৬টি ওয়ার্ড যুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র আনিসুল হকের অকাল মৃত্যুজনিত কারণে শূন্য হওয়া ঢাকার উত্তরের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং নতুনভাবে সংযোজিত ৩৬টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন কমিশন নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ৯ জানুয়ারি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল।

এরপর ১৬ জানুয়ারি দুজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-ভাটারা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান এবং বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমদের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে তফসিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুটি রিট আবেদন করেন। রিটে দাবি করা হয়, সম্প্রসারণের ফলে নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে নির্বাচন না হওয়ার কারণে, আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, ২৮ এপ্রিল ২০১৫ তারিখের মেয়র ও ৩৬টি ওয়ার্ডে কমিশনার পদে নির্বাচন সত্ত্বেও, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন যথাযথভাবে গঠিত হয়নি। [সিটি করপোরেশন আইনের ৫ (৩) ধারা অনুযায়ী, ‘মেয়রের পদ (সহ) করপোরেশনের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে এবং নির্বাচিত কাউন্সিলরদের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হইলে করপোরেশন, এই আইনের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, যথাযথভাবে গঠিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে’। ] এ ছাড়া সম্প্রসারণের কারণে নতুন নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ কত সময়ের হবে, তা-ও নির্ধারিত করা হয়নি। উপরন্তু নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডের ভোটার তালিকা প্রস্তুত হয়নি এবং নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডের অন্তর্গত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের অব্যাহতিসংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করা হয়নি।

রিট দাখিলের দিনে (১৬ জানুয়ারি) আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী, মুস্তাফিজুর রহমান খান ও আহসান হাবিব ভূঁইয়া শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান। শুনানি শেষে বিজ্ঞ আদালত পরদিন আদেশের জন্য ধার্য করেন। একই সঙ্গে আদালতের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীদের রিটের কপি সরবরাহ করতে বলা হয় (ইত্তেফাক, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮)। অর্থাৎ কমিশনের কোনো আইনজীবীর অনুপস্থিতিতেই আদালতে শুনানি হয়। আদালত ১৭ জানুয়ারি বিবাদীদের ওপর রুল জারিসহ নির্বাচনের তফসিল তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন।

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও... (গ) কোন আদালত, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোনো নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্যান্য কোনরূপে কোনো আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।’ কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সচিবের মতে, কমিশন রিটের বিষয়ে আদালতের ‘যুক্তিসংগত নোটিশ’ এমনকি কোনো নোটিশই পায়নি। তবে আদেশের দিনে আদালত থেকে মৌখিক খবর পেয়ে কমিশনের প্যানেল আইনজীবী অনধিক পাঁচ মিনিটের জন্য শুনানিতে অংশ নেন, যদিও এ ব্যাপারে তিনি কমিশনের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন না এবং বিষয়টি নিয়ে তিনি কমিশনের পরামর্শও নেননি। তিনি শুনানিকালে আদালত থেকে সময়ও চাননি (প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারি ২০১৮)।

এটি হতাশাব্যঞ্জক যে আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ডিসিসির নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে গেল। এই অনিশ্চয়তার কারণে সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদ-যে অনুচ্ছেদে আইনানুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হওয়ার কথা-লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সিটি করপোরেশন আইনের উপনির্বাচন সংক্রান্ত ১৬ ধারা অমান্য হওয়ার। সর্বোপরি নাগরিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার। তাই আদালত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শুনে জনস্বার্থে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকাসংক্রান্ত জটিলতা দূর করে পুনরায় তফসিল ঘোষণার আদেশ দিতে পারতেন। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিতে পারতেন এই সময়ের মধ্যে গেজেট প্রকাশ এবং আইনি অস্পষ্টতা দূর করার।

প্রসঙ্গত, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার অনেক আগ থেকেই আইনে অস্পষ্টতা ও ভোটার তালিকাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। আমি নিজেও নির্বাচনসংক্রান্ত সব জটিলতা দূর করার লক্ষ্যে করণীয় সম্পর্কে গণমাধ্যমে একাধিকবার বক্তব্য রেখেছি (উদাহরণস্বরূপ দেখুন, প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮)। এমনকি নির্বাচন কমিশনের সভায়ও এসব জটিলতার কথা আলোচিত হয়েছে, যদিও আদালতের আদেশের পর নির্বাচন কমিশনের সচিব কোনোরূপ আইনি জটিলতার কথা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন, যাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আমরা আরও বিস্মিত হয়েছি যে, সংবিধানের ১২৫ (গ) পূরণের দাবিতে কমিশনের আপিল বিভাগে না যেতে দেখে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, নির্বাচন স্থগিতের ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা ভিলেনসুলভ।

তবে ডিসিসি নির্বাচন স্থগিতের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়ও কোনোভাবেই কম নয়। কারণ, আইনি দুর্বলতা দূর না করেই মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুরোধ করে, যা কোনোরূপ প্রশ্ন ছাড়াই অদৃশ্য কারণে কমিশন লুফে নেয়। প্রসঙ্গত, তফসিল ঘোষণার দিনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন করা এবং নির্বাচনের পরে ‘হয়তো’ স্থানীয় সরকার বিভাগ ওয়ার্ড কমিশনারদের মেয়াদ নির্ধারণ করবে। আর মামলা হলে ইসির কিছুই করার নেই (প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০১৮)।

আদালতের আদেশের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে, জনস্বার্থে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশনের এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের করণীয় হবে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সম্প্রসারিত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদ শূন্য করা। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশন আইনে দুটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র সংশোধনী আনা। আইনের ৫ (৩) ধারায় সংযোজনের জন্য প্রথম সংশোধনীটির ভাষা হতে পারে: ‘তবে শর্ত থাকে যে, আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী সিটি করপোরেশন সম্প্রসারণের কারণে নতুন ওয়ার্ডে পরবর্তীতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইলে পূর্বের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সিটি করপোরেশন আইনগতভাবে যথাযথ বলিয়া গণ্য হইবে এবং ইহার বৈধতা লইয়া প্রশ্ন তোলা যাইবে না।’ আইনের ৬ ধারায় সংযোজনের জন্য অন্য সংশোধনীটির ভাষা হতে পারে: ‘তবে শর্ত থাকে যে, আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী সিটি করপোরেশন সম্প্রসারণের কারণে সম্প্রসারিত ওয়ার্ডে পরবর্তীতে নির্বাচন হইলে নতুন নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মেয়াদ পূর্বে নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের অবশিষ্ট মেয়াদের সমান হইবে।’ সংসদের বর্তমান অধিবেশনেই এ সংশোধনীগুলো পাস করানোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আশা করি, সরকার অনতিবিলম্বে তা করবে।

একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আইনি অস্পষ্টতাগুলো দূর করার জন্য তাগাদা দিতে হবে। পাশাপাশি কমিশনকে ভোটার তালিকাসংক্রান্ত জটিলতা দ্রুততার সঙ্গে দূর করতে হবে। সর্বোপরি দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার ও রুলের নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।

পরিশেষে, এটি বলা আবশ্যক যে, যাঁরা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার ফলে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাঁদের আদালতের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার অনস্বীকার্য। তবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের অধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি আদালতকে সংবিধান, আইন ও জনস্বার্থও সমুন্নত রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও সরকারকেও জনগণের কল্যাণে তথা জনস্বার্থে কাজ করতে হবে। আশা করি, আগামী দিনগুলোতে সংশ্লিষ্ট সবাই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। তাহলেই এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নাগরিকদের আস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য যা অতি অপরিহার্য।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)৷