খাঁটি পুলিশ ভুয়া পুলিশ যখন একাকার

সকাল সাড়ে ১০ টা। রাজধানীর মগবাজার মোড়ের কাছাকাছি জনাকীর্ণ সড়ক। এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন একটি ব্যাংক থেকে। তাঁর হাতে একটা ব্যাগ, ব্যাগে সাত লাখ টাকা। হঠাৎ চারজন লোক তাঁকে ঘিরে ধরেন, তাঁদের কারও হাতে ওয়াকিটকি, কারও হাতে হ্যান্ডকাফ। তাঁরা নিজেদের পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্য বলে পরিচয় দেন এবং লোকটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাশে দাঁড়ানো একটি মাইক্রোবাসে জোর করে ওঠান। সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোবাস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করে। 

রাস্তার লোকজন ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ আর্তচিৎকার শুনতে পায়। তারা দেখতে পায়, ছুটন্ত মাইক্রোবাসটির কাচের জানালায় জোরে জোরে ধাক্কা পড়ছে, সেই সঙ্গে মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মরিয়া চিৎকার: ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ 
রাস্তার জনতার পক্ষে নীরব দর্শকের ভূমিকায় নির্বিকার থাকা সম্ভব হয় না; তাদের মন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সক্রিয় হয়ে ওঠে; তারা চিৎকার করতে করতে ছুটন্ত মাইক্রোবাসটির পিছু নেয়। মাইক্রোবাস কিছুদূর যাওয়ার পরই যানজটে আটকে যায়; উত্তেজিত জনতা সেটির কাচের জানালা ভেঙে ফেলে। কোন ফাঁকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ধারী লোকগুলো তাঁদের ওয়াকিটকি-হ্যান্ডকাফ ফেলে লাপাত্তা হয়ে যান, জনতা শুধু অপহৃত হতে যাওয়া লোকটিকে দেখতে পায়। 
তারপর পুলিশ আসে। জনতা জানতে পারে, যাঁরা লোকটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁরা ভুয়া ডিবি। 

কিন্তু তাঁরা যদি সত্যিই ডিবি পুলিশের সদস্য হতেন বা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হতেন, তাহলে কী ঘটতে পারত? তাহলে সম্ভবত তাঁরা পালিয়ে যেতেন না। তাঁরা পালিয়ে গেছেন বলেই পুলিশ ও জনতার ধারণা হয়েছে যে ডিবি পুলিশের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই, তাঁরা খাঁটি ক্রিমিনাল। 
তবে এ ব্যাপারে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হওয়াও কঠিন। কারণ, পেশাগত পরিচয় দিয়ে, সাদাপোশাকে কিন্তু সশস্ত্র অবস্থায় ছিনতাই, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন, এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের মধ্যে একাধিক আছে। এ রকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে না বটে, কিন্তু ঘটা যে অসম্ভব নয়, তা এ দেশে এখন সবাই জানে। 

মগবাজারের এ ঘটনার খবর ডেইলি স্টার-এ যেদিন ছাপা হয়েছে, সেই একই দিনে প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটা খবর, যেখানে দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ভুয়া নন, পুরোপুরি খাঁটি। তাঁরা হলেন সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক নাজমুল হুদা, কনস্টেবল আবুল কাসেম ও আনসার সদস্য ইসমাইল হোসেন। 
গত বুধবার রাত ১০টার দিকে তাঁরা গিয়েছিলেন সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের তেলিবাজার গ্রামে। গিয়েছিলেন একটা মাইক্রোবাস নিয়ে, সশস্ত্র অবস্থায়, কিন্তু তাঁদের পরনে ইউনিফর্ম ছিল না। সাদাপোশাকে তাঁরা গিয়েছিলেন ‘আসামি ধরতে’। 
প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, সীতাকুণ্ডে ৫০ টির বেশি জাহাজভাঙা কারখানা আছে, সেগুলোতে অনেক শ্রমিক কাজ করেন, তাঁদের অনেকে উল্লিখিত তেলিবাজার গ্রামের বাসিন্দা। শ্রমিক নিয়োগের ঠিকাদার ফারুক হোসেনও ওই গ্রামের বাসিন্দা। বুধবার রাতে তিনি ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ পারভেজ শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন সেখানে সাদাপোশাকে হাজির হন পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ওই তিন সদস্য। তাঁরা দাবি করেন, ফারুকের কাছে ইয়াবা আছে। ফারুকের ভাই পারভেজ তাঁদের কথার প্রতিবাদ করলে তাঁরা পারভেজকে পেটাতে পেটাতে মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করেন। তখন দুই ভাই চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন এবং সাদাপোশাকধারী সশস্ত্র তিন ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান। এতে সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক নাজমুল হুদা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে সবাইকে চলে যেতে বলেন। 

কিন্তু এলাকাবাসী চলে যাওয়ার পরিবর্তে পুলিশের সদস্যদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হন; এর একপর্যায়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে: এসআই নাজমুল হুদা গুলি চালিয়ে দেন। একটি নয়, পরপর মোট নয়টি গুলি ছোড়েন তিনি। গুলিবিদ্ধ হয়ে সাইফুল ইসলাম নামের এক তরুণ মারা যান, আরও দুজন আহত হন। গুলি করতে করতেই তাঁরা মাইক্রোবাসে উঠে ওই জায়গা থেকে চলে যান। 
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন সদস্য, যাঁর দায়িত্ব অন্যায়-অপরাধের শিকার দুর্বল অসহায় মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া এবং অপরাধীদের দমন করা, তিনি নিরপরাধ মানুষকে অপরাধবৃত্তিতে ফাঁসাতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কী অবলীলায় গুলি চালিয়ে নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলতে পারলেন! 

অবাক ব্যাপার হলো, এসআই নাজমুল তাঁর দুই সহকর্মীকে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে তেলিবাজার নামের যে গ্রামে গিয়েছিলেন, সেটা তাঁদের দায়িত্বের এলাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। তাঁরা গিয়েছিলেন সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে না জানিয়েই। কিন্তু তাঁরা সরকারের দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তা ব্যবহার করে অবলীলায় মানুষ হত্যা করে ফিরে গেছেন। তাঁদের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মানুষ হত্যার মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করার পরও তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে লোকজনকে ‘ফাঁসানো’র অভিযোগ ইদানীং অনেক বেড়েছে। গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ মানুষের মুখে ‘পুলিশের জুলুম’ কথাটা আগের চেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। লোকজনকে হয়রানি করে টাকা আদায় করার ঘটনা এতটাই বেড়ে গেছে যে নিরীহ লোকজন ভয়ে ভয়ে থাকে, কখন পুলিশের বদনজরে পড়ে যায়। ঢাকা মহানগরেও যাঁরা পথের পাশে দোকান করেন, বস্তিতে বাস করেন, পুলিশ তাঁদের সহায় নয়। 
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থার সদস্যদের একটা অংশের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা সব সময়ই ছিল। তবে সেই অংশটা আগে অনেক ছোট ছিল। এখন যে বড় হচ্ছে, তা সরকার বা পুলিশ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু স্বীকার করা বা না করার ওপর বাস্তবতা নির্ভর করে না। বাস্তব সত্য হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। গত দুই-তিন মাসেই এমন কিছু ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন গত অক্টোবরে রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকায় পুলিশের এক সহকারী উপপরিদর্শক ও তাঁর এক সহকর্মী একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ছিনতাই করার চেষ্টার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন। নভেম্বর মাসে দক্ষিণখান থানার এক উপপরিদর্শক ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী আলাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি করার সময় ৪০ হাজার টাকা কেড়ে নেন। আলাউদ্দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তরা জোনে এ বিষয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। নভেম্বর মাসেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক ব্যক্তিকে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের দায়ে পুলিশের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

অপরাধ দমন যাদের দায়িত্ব, তাদের একটা অংশই যদি অপরাধে লিপ্ত হয় এবং সেই অংশটা যদি ক্রমশ বড় হতে থাকে, তাহলে পেশাদার অপরাধীদের দমন করার কেউ কি থাকে? পুলিশের সদস্যরা যখন নিজেদের পেশাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা ধরনের অপরাধে লিপ্ত হন, তখন কি তাঁদের পেশাদার অপরাধীদের থেকে আলাদা করে চেনা যায়? তখন কি পেশাদার অপরাধীরাও পুলিশ সেজে অপরাধে লিপ্ত হতে প্রলুব্ধ হতে পারে না? মগবাজারের চার অপহরণকারী নিজেদের ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়েছিল এই ভরসায় যে এতে তাদের অপরাধ সংঘটন নির্বিঘ্ন হবে। ঘটনাক্রমে তা হয়নি, কিন্তু তাদের পক্ষে অপরাধ করে নির্বিঘ্নে চলে যাওয়া অসম্ভব ছিল না; ডিবি পুলিশের মিথ্যা পরিচয় তাদের জন্য বাড়তি সুবিধা হতেও পারত। 
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা যখন অহরহই ঘটতে থাকে, তখন পেশাদার অপরাধীদের পক্ষে ভীষণ সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। দেশজুড়ে এখন সেই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এটা এমন এক সময়, যখন খাঁটি পুলিশ আর ভুয়া পুলিশ আলাদা করে চেনা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। 

প্রশ্ন জাগে, পুলিশ নামের প্রতিষ্ঠানটির মান-মর্যাদা নিয়ে ভাবিত হওয়ার কেউ কি নেই? পুলিশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমে যাওয়া কি কাউকে চিন্তিত করে না? 
প্রশ্ন জাগে, অপরাধীদের দমন করার এবং নিরীহ সাধারণ মানুষকে অন্যায়-অপরাধ থেকে রক্ষা করার আন্তরিক তাগিদ আমাদের এই রাষ্ট্রের কোথাও কি একটুও অবশিষ্ট নেই? 
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। 
mashiul. alam@gmail. com