তৃতীয় বেগম-বৃত্তান্ত!

কার্টুন: শিশির
কার্টুন: শিশির

বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো ও বিশ্লেষকেরা সবাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ হিসেবে দুই নেত্রীর ক্ষমতার লড়াইকে চিহ্নিত করে অভ্যস্ত এবং এটি বর্ণনার জন্য তাঁদের খুব পছন্দের শব্দগুচ্ছ হচ্ছে ‘দ্য ব্যাটলিং বেগমস’। ক্ষমতার সমীকরণে এখন এক তৃতীয় বেগমের আবির্ভাব ঘটায় ওই সব বিদেশির হয়তো কোনো সমস্যা হবে না। কেননা, বহুবচনে কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। কিন্তু বাংলাদেশি সাংবাদিকদের এখন থেকে তিন নেত্রীর রাজনীতির কথা লেখাই বোধ হয় ভবিতব্য। বিশেষ করে, সরকারিভাবে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বেগম রওশন এরশাদের আসীন হওয়ার বিষয়ে সরকারি ঘোষণা (গেজেট) প্রকাশের পর থেকেই যেসব আলামত মিলছে, তাতে মনে হচ্ছে জাতীয় পার্টিতে ইতিমধ্যে একটি অভ্যুত্থান হয়ে গেছে এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এখন কার্যত ক্ষমতাহীন। ক্ষমতাধর এই দাপুটে জেনারেল এখন দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার স্ত্রীর করুণার ওপর নির্ভরশীল। সে কারণেই স্ত্রীর তদবিরে এখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
জাতীয় পার্টির প্রধান জেনারেল এরশাদের জন্য এটি দ্বিতীয় ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনা। ঠিক ২৩ বছর পর। নব্বইয়ের ডিসেম্বরে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন এক গণ-অভ্যুত্থানে, যেটি সম্ভব হয়েছিল দুই নেত্রীর সমঝোতার কারণে। আর এবারে তিনি দলের মধ্যে কার্যকরী ক্ষমতা হারিয়েছেন নতুন আরেক নেত্রীর (রওশন) আবির্ভাব এবং দুই নেত্রীর (শেখ হাসিনা ও রওশন) বোঝাপড়ায়।
জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের (সুবিধাবাদী দল বা আধা সরকারি-আধা বিরোধী দল) নেতা হিসেবে যাঁকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বৃত্তান্ত জানার আগ্রহে জাতীয় সংসদ এবং জাতীয় পার্টির ওয়েবসাইটগুলোয় অনেক কসরত করে একটি লাইনও পেলাম না।
প্রথম আলোর হেড অব রিপোর্টিং শওকত হোসেনকে ফোন করে খোঁজ নিলাম যে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় অথবা সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয় থেকে এ রকম কোনো জীবনবৃত্তান্ত পত্রিকার বার্তাকক্ষে এসেছে কি না। বার্তাকক্ষ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেল যে সে রকম কিছু তাঁদের কাছে আসেনি।
রাজনীতির শীর্ষে এই তৃতীয় বেগমের আবির্ভাবের বিষয়টি যেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু তাঁর গুণাগুণ ও কর্মজীবন পর্যালোচনার বিষয়টিকে আমি জনস্বার্থে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে পারছি না। সুতরাং, তাঁর সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য যতটুকু পাওয়া যায়, সেটুকুর মূল্যায়নেই আপাতত কাজ চলতে পারে বলে আমার ধারণা।
রওশন এরশাদের যে বিষয়টি সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো তা হলো, তিনিই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র নারীনেত্রী, যিনি স্বামীর জীবদ্দশায় রাজনীতিতে স্বামীর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের অধিকারী হলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়েই তাঁদের নিজ নিজ দলের নেতৃত্ব পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। শেখ হাসিনা যেমন তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর অনেক পরে দলের হাল ধরেছেন, তেমনি খালেদা জিয়াও তাঁর স্বামীর মৃত্যুর বছর দুয়েক পর দলের দায়িত্ব নেন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেও দেখা যাবে ভারতে ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কায় শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে, ফিলিপাইনে কোরাজন অ্যাকুইনো, ইন্দোনেশিয়ায় মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী প্রমুখ দলের নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে, হয় বাবা নয়তো স্বামীর মৃত্যুর পর। এমনকি মিয়ানমারের অং সান সু চিও তাঁর স্বাধীনতাসংগ্রামী বাবার উত্তরাধিকার হিসেবে দলের নেতৃত্বে এসেছেন।
ভক্ত নারীকুলের কাছে প্রায় অনন্তযৌবনের অধিকারী বলে পরিচিতি লাভকারী জেনারেল এরশাদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে বাতাসে নানা কথা ভেসে বেড়ালেও স্ত্রী হিসেবে রওশন যে তাঁর পতির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন, তাঁর পুরস্কার তিনি ইহকালেই পেয়ে গেলেন। এরশাদ নিজের ভাবধারা অনুযায়ী জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করলেও তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি অবসর না নেওয়া সত্ত্বেও দলের নেতৃত্বে উত্তরাধিকারের দাবি নিয়ে আসীন হয়ে গেছেন রওশন এরশাদ। দলের ভেতরের সুবিধাবাদী এবং প্রধানমন্ত্রীর অদৃশ্য আশীর্বাদ এ ক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করলেও এ ধরনের বিরল সুযোগ কাজে লাগানোর সাহস কজনের থাকে? বিশেষ করে প্রায় পাঁচ দশকের দাম্পত্য জীবনে যিনি কখনোই স্বামীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস করেছেন, এমন কোনো নজির নেই। বিদিশাকে বিয়ে করা কিংবা অন্য ভক্ত নারীদের সান্নিধ্য চোখ বুজে সহ্য করেছেন যিনি, তাঁর সহ্যশক্তি ও ধৈর্যের যেমন প্রশংসা করতে হয়, ঠিক তেমনি ঝোপ বুঝে কোপ মারার সাহসেরও তারিফ না করে উপায় নেই।
যে আওয়ামী লীগের বদান্যতায় রওশন দশম সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, সেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর (মতিউর রহমান) কাছেই হেরে যাওয়ায় নবম সংসদ তাঁর নেতৃত্ব অথবা অবদান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে তিনি এমনকি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন না। তবে, তাঁর স্বামী সাবেক স্বৈরশাসক গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনটি সংসদেই তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর সংসদে উপস্থিতি বা সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণের রেকর্ড সংসদে উপর্যুপরি এবং অব্যাহত অনুপস্থিতির অভিযোগে অভিযুক্ত বিরোধী দলগুলোর চেয়ে যে খুব একটা বেশি, তেমন নয়। ময়মনসিংহের যে নির্বাচনী এলাকার তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই এলাকায়ও তিনি কালেভদ্রে যাতায়াত করেন কি না, সন্দেহ। যত দূর মনে পড়ে, ২০০৬ সালের অক্টোবর বা নভেম্বরে ময়মনসিংহের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ মিলনায়তনে বিবিসির বাংলাদেশ সংলাপ অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় এবং সেটাই শেষ। অনুষ্ঠানের জন্য তিনি দুপুরের পর ঢাকা থেকে সেখানে গিয়েছিলেন এবং রাতেই আবার ফিরে আসেন। তাঁর দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা তাঁকে সংবর্ধনা জানানো এবং তাঁর সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলার সুযোগ না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
বিবিসির একজন সাবেক সাংবাদিক কাজী জাওয়াদের একটি পর্যবেক্ষণ এখানে উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন যে দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনেই রওশন এরশাদ একজন ঝানু রাজনীতিকের মতো বক্তব্য রেখেছেন। অর্থাৎ যা বলেছেন, সেটা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, এটা দুঃখজনক।’ কাজী জাওয়াদ বললেন যে এটা তাঁর মনের কথা হতেই পারে না। কেননা, বিএনপি নির্বাচনে এলে বিরোধী নেত্রীর আসনে আসীন হতেন হয় খালেদা জিয়া, নয়তো শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার কৃপানির্ভর বিরোধী নেত্রীর দপ্তরটিতে তাঁর তো তাহলে কোনো জায়গা হতো না।
জাতিসংঘের ইউএন উইমেন ও ইউএন কমপ্যাক্ট নামের দুটি প্রতিষ্ঠান নারীর ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করার জন্য উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট প্রিন্সিপালস নামে একটি কার্যক্রম পরিচালনা করে, যার অংশ হিসেবে নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য প্রতিবছর তারা উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড দিয়ে থাকে। ২০১৩ সালের পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের সময়টা শেষ হয়েছে ২ ডিসেম্বর। রওশনের ক্ষমতায়নটা যদি আর কয়েক সপ্তাহ আগে ঘটত, তাহলে বাংলাদেশ থেকে অন্তত দুজন এ জন্য মনোনীত হতে পারতেন। ২০১৪ সালের পুরস্কারের মনোনয়নের জন্য অবশ্য এখনো প্রায় ১০ মাস বাকি আছে!

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।