মানুষের মুখোমুখি বিচারকেরা

কুলদীপ নায়ার
কুলদীপ নায়ার

এটা সেই প্রবাদের চায়ের কাপে ঝড় হোক বা না হোক, সত্যটা হলো ভারতীয় বিচার বিভাগের কঙ্কালটা বেরিয়ে গেছে। রাষ্ট্রের এই স্তম্ভ যে নিরপেক্ষতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, তার ভিত নড়ে গেছে। এই প্রথমবারের মতো বিচারকেরা মানুষের মুখোমুখি হলেন। এ ঘটনার এটাই সেরা শিরোনাম, এক উর্দু দৈনিকে এটি দেখলাম। এতে যেমন গল্পটা বলা হয়ে গেছে, তেমনি অনেক কথা না-বলা রয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারক জে চেলমেশ্বর, রঞ্জন গগৈ, মদন বি লোকুর ও কুরিয়ান জোসেফ সংবাদ সম্মেলন করে ইতিহাস রচনা করলেন। ভারতের প্রধান বিচারক দীপক মিশ্র কী করছেন, সে সম্পর্কে তাঁরা নিজেদের গল্পের দিকটা বললেন। এই চার বিচারপতির বক্তব্যের সারকথা হলো প্রধান বিচারপতি তাঁদের সমগোত্রীয়, তিনি কেবল তাঁদের মধ্যে প্রথম, এর বেশি কিছু নন, কমও নন। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, প্রধান বিচারপতি সব জায়গাতেই হাত দিয়েছেন।

সর্বোচ্চ আদালতের চারজন জ্যেষ্ঠ বিচারক কর্তৃক জনসমক্ষে প্রধান বিচারপতিকে প্রশ্ন করার ঘটনায় সবাই বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তবে সরকার হস্তক্ষেপ না করে ব্যাপারটা বিচার বিভাগের হাতে ছেড়ে দিয়ে সঠিক কাজটি করেছে। আর সাবেক প্রধান বিচারপতিরাও যে এমন অভূতপূর্ব ঘটনায় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়েছেন, তা বোধগম্য। সাবেক প্রধান বিচারপতি আর এম লোধা তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এমন একটি উত্তপ্ত বিষয় কীভাবে দুই মাস ঝুলে থাকল? তিনি আরও বলেছেন, ‘আজকের ঘটনায় আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। যে ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন, তাঁর কাছে এই ঘটনা দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনক।’ এ ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ায় এই সাবেক প্রধান বিচারপতি সঠিকভাবেই বলেছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতির উচিত ছিল এ বিষয়ে আলোচনা করা।

চার বিচারপতি যে অভিযোগ করেছেন তা হয়তো বড় কিছু নয়। কিন্তু প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জে চেলমেশ্বর পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন। ব্যাপারটা হলো বিচারপতি চেলমেশ্বর শীর্ষ পাঁচ বিচারকের এক বেঞ্চের কাছে মেডিকেল কলেজের দুর্নীতির এক মামলায় তদন্তের আবেদন পাঠালে পাঁচ বিচারকের সংবিধান বেঞ্চ তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, কোন মামলা কোন বেঞ্চের কাছে যাবে তা নির্ধারণের এখতিয়ার কেবল প্রধান বিচারকের।

এমনকি ইদানীং সংবিধানের বাইরে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ গঠন হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কারণ, পাঁচ বিচারকের বেঞ্চে এর শুনানি হতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি এ ব্যাপারগুলো দুই বা তিন বিচারকের বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে। এতে শুধু সর্বোচ্চ আদালতের অন্য বিচারকদের আত্মবিশ্বাস বিঘ্নিত হয়নি; বরং এক সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিচারকদের মধ্যে মতভেদ নতুন কিছু নয়। আগেও সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। কিন্তু সেই ঘটনাগুলো ছিল ‘নিয়মভঙ্গের নিদর্শন’, তা বিদ্রোহ ছিল না। ভিন্নতা যা-ই থাক না কেন, কর্মরত বিচারকদের এই সংবাদ সম্মেলনের কারণে এই প্রতিষ্ঠানের অখণ্ডতা বিঘ্নিত হয়েছে। এতে সুপ্রিম কোর্টের নৈতিক কর্তৃত্বও ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে চার বিচারক যে চিঠি লিখেছেন, সেখানে তাঁরা সঠিকভাবে সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন, যাতে তাঁরা অনুরূপ বিচারিক ব্যাপারে তাঁকে অবহিত করতে পারেন, যেসব ব্যাপার প্রধান বিচারপতির আমলে নেওয়া দরকার।

আইনের শাসনের ভিত্তিতে রচিত আইনি ব্যবস্থায় প্রধান বিচারপতিসহ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। সন্দেহ নেই, প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ গঠনের অধিকার আছে, কিন্তু তাঁকে সেটা বিচারিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে, স্বেচ্ছাচারী ঢঙে নয়। সরকার ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন বাস্তবায়নের সুযোগ খুঁজছে, বিচারকেরা যা প্রত্যাখ্যান করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিচারকেরা হয়তো অনুধাবন করতে পারেননি যে এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে তাঁরা সরকারকে সেই সুযোগ দিয়ে ফেলেছেন। আর সরকার সেটা একবার বাস্তবায়ন করে ফেললে বিচারকদের নিয়োগ ও বদলিতে সরকারের কর্তৃত্ব বাড়বে।

স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের বিচার বিভাগ স্বাধীন, ভারতকে তাই ভাগ্যবান বলা যায়। কিন্তু ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারক এইচ আর খান্না ও এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারক জগমোহন লাল সিনহা বিচার বিভাগকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন এমন একসময়, যখন বিচার বিভাগ অত সাহসী ছিল না এবং সে তখন কেবল নিজের ঘর গোছাত। জরুরি অবস্থার সময় পরিণতির কথা জেনেও খান্না সত্য বলেছেন। তিনি চার সহকর্মীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনীয়—এই মতে অটল থাকেন। এরপর তাঁকে ডিঙিয়ে অন্য আরেকজনকে পদোন্নতি দেওয়া হলে প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন।

দীপক মিশ্র এ বছরের অক্টোবর মাসে অবসর গ্রহণ করলে রঞ্জন গগৈ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। তখন তাঁকে হয়তো বিচারক খান্নার মতো একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু বিচারক খান্নার রায় ভারতের মানুষকে আশান্বিত করেছিল যে দেশে সত্য ঊর্ধ্বে তুলে ধরার মতো বিচারক আছেন, যেখানে প্রধান বিচারপতি চাকরি বাঁচাতে আপস করেছিলেন। খান্না জাতির উদ্দেশে বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রত্যেক নাগরিকের সতর্কতা ও ত্যাগের মানসিকতা দাবি করে। ভারতের জন্য এটা এখনো অনেক দূরের স্বপ্ন।

এসব উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও বিচার বিভাগ ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে। মানুষ যে বিচার পাবে, সেই আশা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বিচারে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব নয় শুধু, বিচারকদের হাতের মুঠোয় নেওয়া যায়—এই বোধের কারণেও তেমনটা হচ্ছে। ভারতের বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা যোগসাজশ করে সুনির্দিষ্ট বিচারকের আদালতে মামলার শুনানি করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। বছর কয়েক আগেও দুর্নীতি শব্দটা শোনা যেত না। আজ সেটা সবার মুখে মুখে।

বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন বিচারপ্রক্রিয়া গরিবমুখী ও পরিবেশবান্ধব ছিল। এমনভাবে আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হতো, যাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেতে পারে। আর ভবনের আগ্রাসন থেকে সবুজ রক্ষা পায়। বিশ্বায়নের পর থেকে বিচার বিভাগ ধনীদের পক্ষাবলম্বন করতে শুরু করেছে, যারা ক্ষমতাবলে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করছে। এমনকি বিচার বিভাগ আইন বিভাগের ক্ষমতাও দাবি করতে শুরু করেছে। বিচার বিভাগ আমাদের জনজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শুধু আইনের মাধ্যমেই রাজনীতিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখা যায়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা যদি আইন নিয়ে না ভেবে শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবেন, তাহলে গণতন্ত্র বিপদের মুখে পড়তে পারে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।