২ কোটি মানুষের ভরসা রংপুর মেডিকেল

রংপুর বিভাগের আট জেলার প্রায় দুই কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। জেলা-উপজেলাভিত্তিক হাসপাতাল থাকলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের এখানেই আসতে হয়। প্রতিবছর গড়ে চার লক্ষাধিক মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। প্রতিদিন গড়ে একটি বিভাগে রোগী ভর্তি থাকে প্রায় ১ হাজার ৮০০। দিনে তিন শতাধিক রোগী জরুরি সেবা গ্রহণ করে। ১৯৬৮ সালে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখানে সেবা প্রদানের

পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেবার মানও বাড়ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় এই অঞ্চলের বাস-ট্রাক-ট্রেনে আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পেয়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে আইসিইউ সেবাকেন্দ্র রয়েছে, তা বাংলাদেশের যেকোনো উন্নত সেবাকেন্দ্রের সমতুল্য।

২৫ জানুয়ারি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কনফারেন্স রুমে টিআইবির সহযোগিতায় সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। উদ্দেশ্য Ñছিল সেবার মান বৃদ্ধিকল্পে সেবাগ্রহীতার পরামর্শ গ্রহণ। সেখানে উপস্থিত ছিলাম বলে অনেক কিছু জানার সুযোগ হলো। শুরুতেই পরিচালক অজয় রায় সেবাগ্রহীতাদের কাছে সেবার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে চান। তিনি বলেন, ‘আমরা সেবার মান বাড়াতে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে চাই।’

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি রংপুর জেলা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। তিনি এমআরআই করিয়েছেন কিছুদিন আগে। তিন-চার দিন ঘোরার পর তিনি এমআরআই করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু মেশিনে শরীর ঢোকানোর পর কয়েকবার মেশিন বন্ধ হয়। তাঁর প্রশ্ন হচ্ছে যাঁরা পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম থেকে আসবেন, তাঁদের এমআরআই হবে কী করে? তবে হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।

লাশ পরিবহনের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অসাধু সিন্ডিকেটের হাতে ছিল। যেখানে সরকারি ভাড়া মাত্র ২ হাজার টাকা, সেখানে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় যেতে বাধ্য করতেন এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। অন্য গাড়িতে তাঁরা লাশ তুলতে দিতেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স চালু করার পর সেই ভাড়া নেমে এসেছে মাত্র ২ হাজার ৫০০ টাকায়। দৌরাত্ম্যও কমেছে। মেডিকেলের ভেতরে অনেক কিছুই এখনো অসাধু সিন্ডিকেটের হাতে। সহকারী পরিচালক রফিকুজ্জামান বলছিলেন, ‘পুলিশ-আর্মি দিয়ে এখান থেকে দালাল বন্ধ করা যাবে না। মেডিকেলের পূর্ব গেট ও পশ্চিম গেট-সংলগ্ন স্থানীয় ব্যক্তিদের কেউ কেউ দালালি করে থাকেন। তাঁদের হাত থেকে হাসপাতাল রক্ষা করতে হবে।’ চিকিৎসা নিতে আসা একজন অন্ধ মুক্তিযোদ্ধা চাঁদা না দেওয়ায় তাঁর পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলেছিল একজন চাঁদাবাজ; এ ঘটনাও তিনি উল্লেখ করলেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দেখভাল করার দায়িত্ব হাসপাতাল পরিচালকের। কিন্তু সহকারী অধ্যাপক থেকে শুরু করে অধ্যাপক পর্যন্ত চিকিৎসকেরা অধ্যক্ষের কাছে দায়বদ্ধ। ফলে হাসপাতাল অংশে চিকিৎসকদের সঙ্গে পরিচালকের সমন্বয় করা অনেক সময় সম্ভব হয় না।

হাসপাতালের কিছু কিছু কাজ গণপূর্ত বিভাগের ওপর ন্যস্ত। লিফটের অবস্থা ভালো নয়। কয়েক দিন আগে একজন রোগী লিফটের নিচে পড়ে মারা গেছে। এই লিফটের তদারক করে গণপূর্ত বিভাগ। হাসপাতালের লিফট, অথচ কর্তৃত্ব গণপূর্ত বিভাগের।

লাশ রাখার হিমঘরের অবস্থাও ভালো নয়। চারটি ফ্রিজে মোট ২৪টি লাশ রাখা যায়। কয়েক দিন আগে এর মধ্যে দুটি ফ্রিজই নষ্ট ছিল। একটি লাশ আছে ২০১৩ সাল থেকে। মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লাশ সরানোর উপায় নেই। এই ফ্রিজ তাৎক্ষণিক মেরামতের উপায় নেই। যে কোম্পানির ফ্রিজ, সেই কোম্পানির টেকনিশিয়ান দিয়েই ঠিক করতে হয়। এই জটিলতা না থাকলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত ফ্রিজ ভালো করার ব্যবস্থা করতে পারত।

অপারেশন থিয়েটার ও চিকিৎসকের স্বল্পতার আরেকটি চিত্র পরিচালক অজয় রায় তুলে ধরেন, ‘নিউরোসার্জারি বিভাগে সব সময় ৮০-৯০ জন অপারেশনের রোগী ভর্তি থাকে। কিন্তু অপারেশন থিয়েটার আছে মাত্র একটি। একটি অপারেশন করতে সময়ের প্রয়োজন হয় দুই থেকে ছয় ঘণ্টা। তাহলে কীভাবে এতগুলো রোগীর অপারেশন প্রতিদিন করা সম্ভব?’ তবে তিনি নিরাশ নন, পরিস্থিতির উত্তরণ হবে।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি আছে। এই কমিটি আরও সক্রিয় করা প্রয়োজন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে পারলে সেবার মান বৃদ্ধিতে তা সহায়ক হতে পারে। সেই সঙ্গে তদারকির ধরনও পাল্টানো প্রয়োজন। একজন পরিচালকের পক্ষে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা কঠিন।

চিকিৎসকেরা অনেক সময় রাষ্ট্রীয় অবিচারেরও শিকার। তা সত্ত্বেও তাঁরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যান। কখনো কখনো বিনা অপরাধেও হেনস্তা হন। নিজের দেখা একটি ঘটনা বলি: এক চিকিৎসক উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসকের স্বল্পতার কারণে পাঁচ দিন পাঁচ রাত একটানা ডিউটি করেছেন। দুপুরে একটু খেতে গিয়েছিলেন কোয়ার্টারে। এটুকু সময় চিকিৎসক না থাকার কারণে রোগীর লোকজন মারমুখী হয়েছিলেন। চিকিৎসকের এই ত্যাগ স্বীকারের মূল্য না আছে জনগণের কাছে, না আছে রাষ্ট্রের কাছে।

চিকিৎসকদের সঙ্গে সেবাগ্রহীতার মতবিনিময় সভায় লেখক ও চিকিৎসক মফিজুল ইসলাম শুধু চিকিৎসকদের দোষারোপ না করে নিজেদেরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘একবার একজন ডাক্তার মেডিকেলে আসতে বিলম্ব করেছিলেন। রোগীর লোকজন তাঁকে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকলে হাসপাতালের বয় এসে রোগীর লোকজনকে বলেন, আপনারা এসব কী বলছেন? স্যার নিজের ছেলের জানাজা পড়েই আপনাদের চিকিৎসা করার জন্য এসেছেন।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক আশার কথা শোনাল। প্যাথলজির সব মেশিন এখন ভালো আছে। কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কত টাকা প্রয়োজন, তা রোগীদের জানানোর ব্যবস্থা রয়েছে। সম্প্রতি অনেকগুলো বিভাগে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, কিডনি ওয়ার্ড চালু হয়েছে। আর ডিজিটাল অভিযোগ বক্স চালু আছে। যেকোনো ধরনের অভিযোগ সরাসরি মন্ত্রণালয়ে জানানোর সুযোগ আছে। মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

চিকিৎসাপদ্ধতির দুর্বলতাজনিত কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর সমস্ত দায় চিকিৎসকদের নয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই হাসপাতালকে রংপুর বিভাগের সব মানুষের চিকিৎসাসেবার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা তৈরি করতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রতি সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা জরুরি।

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]