পথ পথিকের

ফুটপাত বহু বছর ধরেই দখল করে নিয়েছে দোকানি-হকার
ফুটপাত বহু বছর ধরেই দখল করে নিয়েছে দোকানি-হকার

ফুটপাতে মানুষ হাঁটবে, মানুষের এইটুকু অধিকারের কথা বলতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে হামলার শিকার হতে হয়েছে। দেশের একমাত্র মহিলা মেয়র ফুটপাতে মানুষের অধিকার কায়েমের কথা বললেন। এ কথা স্বীকার্য যে পথ পথিকের। শতসহস্র বছর ধরে মানুষ পর্বতগাত্রে, সমতলভূমিতে, খেতের আল দিয়ে পথ নির্মাণ করেছে। সে সময় পদব্রজের। পায়ে হেঁটে পরিব্রাজকেরা শত শত মাইল ভ্রমণ করেছেন।

যন্ত্রসভ্যতার কালে অবশ্য মানুষের পথ সংকুচিত হয়েছে। ফুটপাত নামক অপরিসর পথপার্শ্বে তার ঠাঁই হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই স্থানটুকু বহু বছর ধরেই দখল করে নিয়েছে দোকানি-হকার। পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দোকানির দেশও বলা যায়। যেখানে-সেখানে দোকান। পথে, স্টিমার-লঞ্চের ঘাটে, বাসস্টেশনে, ট্রেনস্টেশনের বিধিবদ্ধ দোকান বাদ দিয়ে পুরো এলাকাই দোকানিদের দখলে। দেশের শহর এলাকাগুলোতে নিত্যনতুন দোকানের ছড়াছড়ি। পৌর প্রশাসন স্টেডিয়াম, জলাশয়, খেলার মাঠ, সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ, লাইব্রেরি-সব জায়গায় দোকানের জায়গা অধিকার করেছে এবং বিপুল অর্থের লেনদেনের ব্যবস্থা হচ্ছে। দোকান মানেই অর্থ। আজকে আর হাটবাজারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকাও নেই। উপজেলা শুধু নয়, একেবারে গাঁও-গ্রামেও মার্কেট শুধু নয়, সুপারমার্কেটের দালান গড়ে উঠেছে। ঢাকা এখন দোকানের নগর।

দেশের সিনেমা হলগুলো রাতারাতি সুপারমার্কেটে রূপান্তরিত; এমনকি নাট্যমঞ্চগুলো ভেঙেও সেখানে মার্কেট করতে হবে। জেলা শহরগুলোতে জিনিসপত্রের দোকান ছাড়াও কিছু শিক্ষার দোকান গড়ে উঠেছে। কোচিং সেন্টার নামে এসব শিক্ষা ধ্বংসের সর্বগ্রাসী দোকানিরা পোস্টার-ফেস্টুন দিয়ে একেবারেই শহরের দিগন্তকে ঢেকে ফেলেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঢাকার বাইরের শহরগুলোও জনাকীর্ণ হয়ে পড়েছে এবং কিছুটা প্রবৃদ্ধি বাড়ার ফলে দোকানপাটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই শহরগুলোতে কেনাকাটাও প্রচুর। সব ব্র্যান্ডের দোকানও রয়েছে এসব শহরে। সেখানেও ফুটপাত সংকুচিত। কোথাও কোথাও ফুটপাতের ওপর মোটামুটি দোকানপাটের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও পাকা।

চার লেনের বেশ কয়েকটি রাজপথ হয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইলের যেটুকু রাস্তা চার লেন হয়েছে, সেখানে দুটি লেন মোটামুটি গাড়ির গ্যারেজ ও দোকানপাট দখল নিয়ে নিয়েছে। রাস্তা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তা না জেনে, না বুঝে যার যার সুবিধামতো বেচাকেনার জায়গা যদি হয়ে যায়, তাহলে এত বড় বড় রাস্তা করে কী হবে? আর সেই রাস্তা দিয়ে কি চলাচলের সুবিধা হবে?

দেশে প্রচুর রাস্তাঘাট হয়েছে সন্দেহ নেই কিন্তু যানজট তবু কমছে না। কয়েকটি প্রধান রাস্তা ব্যবহারে বিশৃঙ্খলা। ঢাকা শহরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এখনো রয়ে গেছে সেই প্রাচীন ম্যানুয়েল পদ্ধতির। কয়েক বছর আগেও লাল বাতি, সবুজ বাতি, হলুদ বাতির স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ছিল, এখনো তা চালু আছে কিন্তু যন্ত্রকে অমান্য করে তা মানুষ হস্তগত করেছে। বিপুল বিশাল এই শহরের জটিল যান নিয়ন্ত্রণ কতিপয় ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে কী করে সম্ভব? আর ওই যে অসহায় বাতিগুলো দিনরাত জ্বলে জ্বলে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ বিল হচ্ছে, তার টাকা কে দেবে? এই অসহায় নাগরিকেরাই তো। এই ব্যবস্থার মধ্যে গাড়ি চালান, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের গাড়ির চালকেরা আইন অমান্য করে উল্টো পথে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোটরসাইকেল আরোহী। সময় বাঁচাতে গিয়ে এই চালকেরা ট্রাফিক আইন অমান্য করে উল্টো পথে এমনকি ফুটপাত দিয়েও গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ির মালিকদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশ বা সার্জেন্ট যে কত অসহায়, তার অনেক ঘটনাই শহরবাসী জানে। মোটরসাইকেল ফুটপাতের পথিকের অধিকার কেড়ে নিয়ে এখন তাদের রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে।

যতটুকু রাস্তা আছে সে অনুপাতেই গাড়িঘোড়া থাকা প্রয়োজন। ঢাকা বা দেশের বড় শহরের মধ্যে কত গাড়ি, রিকশা, ট্যাক্সি, মোটরসাইকেল চলতে পারে, তার পরিসংখ্যান কোথায় আছে জানি না। তবে সাধারণ জ্ঞানে গাড়ির চাপ থেকে অনুমান করা যায়, পরিমাণের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি গাড়ি রয়েছে। তবু প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি বিক্রি হচ্ছে এবং সেগুলো রাস্তায় নামছে। চট্টগ্রাম বন্দরেও রাতদিন গাড়ি খালাস হচ্ছে। জার্মানি, জাপানসহ অন্যান্য দেশে গাড়ি কিনে পনেরো বছর রুট পারমিটের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এখানে এক দিনও না। রাজস্ব বিভাগ গাড়ির ওপর কর বাড়িয়ে সরকারের আয় বাড়াচ্ছে বটে কিন্তু জনজীবন যে পর্যুদস্ত হচ্ছে সেদিকে খেয়াল করছে না। আবার ব্যাংকগুলো গাড়ি কেনার ঋণ দিতে গাড়ির দোকানে গিয়ে ধরনা দিচ্ছে।

গাড়ির জন্য ব্যবহৃত জ্বালানি গ্যাসের মজুতও কমে আসছে। বিপুল পরিমাণ তেল আমদানির প্রয়োজন পড়বে শিগগিরই। হাজার হাজার গাড়ি বিক্রি হচ্ছে কিন্তু সে তো বিদেশি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি। দেশে কি একটা গাড়ির কারখানা হতে পারে না, যেখানে গাড়ির এত বড় বাজার? রাশিয়ার জার পিটার দ্য গ্রেট একবার বলেছিলেন, ‘আমি রাশিয়ার জার না হয়ে পোল্যান্ডের শ্রমিক হলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতাম; কারণ, আমার দেশে একটিও গাড়ির কারখানা নেই। এখন তো যৌথ মালিকানাধীন গাড়ির কারখানা সম্ভব।’

ফুটপাত দখলের প্রয়োজন দরিদ্র হকারদের স্বার্থে যে নয়, তা প্রমাণের অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। সবটাই ক্ষমতাবানদের কালোটাকা উপার্জনের উপায়। পথঘাট যে মানুষের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, একটা চরম বিশৃঙ্খলা এবং সময়ের বিশাল অপচয় হচ্ছে, যার ফলে মানুষের জন্য নগর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কি আমরা তাকাব? নাকি নগরের ভিআইপিদের স্বার্থে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাকে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ওপর ছেড়ে দেব? এই শহরের মধ্যেই যদি সেনানিবাস এলাকায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল কঠোরভাবে কার্যকর রাখা যায়, তবে সর্বত্র তা সম্ভব নয় কেন? আমাদের সরকার সবকিছু একাই করতে চায় তার প্রশাসনের মাধ্যমে। জনগণকেও সম্পৃক্ত করা দরকার। পাড়া-মহল্লার নাগরিকদের এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। উল্টো পথের গাড়ি, মোটরসাইকেল বা রিকশাচালকদের বিরুদ্ধে জনগণও পুলিশকে সহযোগিতা করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। একটি দেশের শৃঙ্খলা বোঝা যায় রাস্তায় নামলে। দেশটা যেহেতু সবার, তাই একটি বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রের নাগরিক কে হতে চায়?

মামুনুর রশীদ অভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক।