তবু শিশুরা ডুবছে জলে

খাল-বিলের পানি কমতে শুরু করেছে। অনেক জায়গায় পুকুর-ডোবা প্রায় শুকিয়ে গেছে। কাদাজলে মাছ ধরার ছবি ছাপা হচ্ছে কাগজে কাগজে। অনেক জায়গায় গোসলের পানি নেই। তারপরও পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর খবরের কোনো ঘাটতি নেই।জানুয়ারি
মাসে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবর এসেছে ময়মনসিংহের গফরগাঁও, পাবনার চাটমোহর, রাজশাহীর পুঠিয়া, ফরিদপুরের চরভদ্রাসন, হবিগঞ্জের মাধবপুর, ঝালকাঠির রাজাপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ইত্যাদি অঞ্চল থেকে। আবার এসব দুর্ঘটনার অনেক খবর আমাদের অগোচরেই থেকে যায়।
২০১৭ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় তার বাংলাদেশের তিন সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে করা এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছিল। সেই গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এটা পাঁচ বছরের কম বয়সী মোট শিশুমৃত্যুর প্রায় ৪৩ শতাংশ। নানা প্রতিষেধকের আবিষ্কার আর টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের জন্য অসুখ-বিসুখে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে ঠিকই, কিন্তু সে জায়গা এখন দখল করছে নানা রকমের দুর্ঘটনা, বিশেষ করে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু।
২০১৬ সালের ঘটনাপুঞ্জিভিত্তিক এই গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন নানা দুর্ঘটনায় গড়ে ১২৫টি শিশু মারা যাচ্ছে। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষদের এই হিসাবের মধ্যে আনা হয়েছিল। সেই হিসাবে দেখা যায়, নানা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া শিশুদের মধ্যে প্রায় ২৪ শতাংশই মারা যায় পানিতে ডুবে। সব শিশু যে নদীতে বা পুকুরে ডুবে মারা যাচ্ছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। শহরে বাথরুমে পানি ধরে রাখা বালতিতে ডুবে মারা যাওয়ার মর্মান্তিক খবর নতুন নয়। গত ২৭ জানুয়ারি ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের ডাঙ্গাগ্রামের দেড় বছরের শিশু মাহিম মারা গেছে বাড়ির টিউবওয়েলের পানি যাওয়ার গর্তে পড়ে।

অনেক খবরে দেখা যায়, একটি নয়, শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে জোড়ায় জোড়ায়, কখনোবা তিন বা চারজন একসঙ্গে। যেমন মাহিমের দুর্ঘটনার তিন দিন আগে ২৪ জানুয়ারি কুষ্টিয়া সদরের আইচরায় দুই আপন চাচাতো ভাইবোন রাবেয়া আর নাফিজ বাড়ির ঠিক পাশেই পুকুরের নালার মধ্যে পড়ে মারা যায়। ধারণা করা যায়, দুজন একসঙ্গে খেলতে খেলতে কেউ একজন নালায় পড়ে গেলে আরেকজন তাকে উদ্ধারে এগিয়ে গেলে দুজনেরই মৃত্যু হয়। গত বছরের আগস্ট মাসে ঠিক এমনটি ঘটেছিল টাঙ্গাইলে। দুই ভাইবোন ঝুমু (১০) আর শুভ (৭) ভেলা নিয়ে বাড়ির পাশের বিলে শাপলা তুলতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। প্রথমে শুভ পানিতে পড়ে গেলে ঝুমু তাকে উদ্ধারের জন্য পানিতে লাফিয়ে পড়লে দুজনেই ডুবে মারা যায়।

আপন ভাইবোন ছাড়াও নানাবাড়ি বা দাদাবাড়ি কিংবা মামার বাড়ি বেড়াতে এসে মামাতো-ফুফাতো বা খালাতো-চাচাতো ভাইবোনের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার কথা হরহামেশাই খবরে আসছে। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই কুমিল্লার লাকসামে নানাবাড়ি বেড়াতে এসে জান্নাতুল মাওয়া আর তার খালাতো বোন আলিয়া বাড়ির পাশে আমন ধানের জলাবদ্ধ খেতে ডুবে মারা যায়। ২০১৬ সালে প্রায় একই ধরনের দুর্ঘটনায় ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের মামুনশিয়া গ্রামে পানিতে ডুবে মারা যায় দুটি শিশু।

২০১৭ সালে ২৬৮টি দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া ৩৬৪ জনের ওপর একটা সমীক্ষা চালিয়ে দুর্যোগ ফোরাম দেখেছে, এদের মধ্যে ২৪৪ জনই হচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৬ বছরের নিচে) আর ৮ বছরের নিচে শিশুর মোট মৃতের প্রায় ৫১ শতাংশ (১৮৬ জন)। আলোচ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা মায়ের খুব কাছেই এক শ থেকে দেড় শ গজের মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। ডুবে মারা যাওয়ার সময়টাও কাকতালীয়ভাবে খুব কাছাকাছি; বেলা ১১টা থেকে ২টার মধ্যে। এই সময় মায়েরা রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকেন। শিশু একটু চোখের আড়াল হলেই বিপত্তি ঘটে যাচ্ছে।

ধানের চাতালে কাজ করার সময় এক মা তাঁর ছোট্ট শিশুকে শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখার ছবি বছর কয়েক আগে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। ছবিটি ছিল নিরুপায় মায়ের এক জুতসই সমাধান। ঝিনাইদহের এক মা তাঁর প্রতিবন্ধী শিশুকে প্রতিদিন শিকলে বেঁধে রেখে কাজে যেতেন। সে করুণ ছবিও সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে আমরা দেখেছি।

আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যগত কারণে শিশুর মৃত্যু রোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিসরের মধ্যে চিকিৎসা আর প্রতিষেধক ছাড়া অন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার না থাকলেও আমাদের চিরাচরিত ‘লক্ষ্মণরেখার’ বাইরে এসে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার আর সমাজকে সম্পৃক্ত করে একটা কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

উপমহাদেশে ৫ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম ভারতের কেরালা রাজ্যে। সে রাজ্যের সরকার স্কুলে যাওয়ার বয়স না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেখাশোনার একটা সামাজিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছিল। অঙ্গনবাড়ি নামের এই ব্যবস্থাপনা গ্রামের মায়েদের সম্পৃক্ত করে গড়ে তোলা হয়। গ্রামের মায়েরাই অঙ্গনবাড়ি কেন্দ্রের দেখাশোনা করেন ভাগাভাগি করে। ৩০ পরিবারের একটি অঙ্গনবাড়িতে গড়ে এক দিন এক মায়ের দায়িত্ব পড়ে। কেরালা ছাড়িয়ে এখন এই ব্যবস্থা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশে একাধিক বেসরকারি সংস্থা পরীক্ষামূলকভাবে কোথাও আঁচল, কোথাও আপনঘর ইত্যাদি নামে এই ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করছে। তবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে সমাজের সবার অংশগ্রহণে এটার একটা স্থায়ী রূপ দিতে না পারলে বেতন দিয়ে আর ঘর ভাড়া করে এটা বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়