ইতালির নির্বাচনেও অভিবাসী বিদ্বেষ

ইউরোপে উদারনৈতিক রাজনীতির এখন বেহাল অবস্থা। সর্বত্র তথাকথিত জনতুষ্টিবাদী ও জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীলদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর রাজনীতি। ইউরোপের নানা দেশের পর এবার ইতালির নির্বাচনকে ঘিরে তারা মাঠে নেমেছে।

পূর্ব ইতালির মাসেরাতা শহরের দুটি অপরাধমূলক ঘটনা এখন ইতালির পার্লামেন্ট নির্বাচনের মূল নিয়ামক হতে চলেছে। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে একজন ইতালীয় নারীকে হত্যার অভিযোগে নাইজেরিয়ার নেশাগ্রস্ত একজন অভিবাসী অভিযুক্ত হন। এর পরপরই চলন্ত গাড়ি থেকে একজন ইতালিয়ান যুবক কিছু আফ্রিকান অভিবাসীর ওপর গুলি চালান। এতে পাঁচজন আফ্রিকান আহত হন। এরপর গলায় ইতালির পতাকা জড়ানো এই যুবক চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ইতালি, ইতালির নাগরিকের জন্য, পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করুক।’ তাঁকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, ওই ব্যক্তি গত বছর অভিবাসনবিরোধী একটি দল থেকে আঞ্চলিক নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।

ইতালির নির্বাচনের প্রাক্কালে মাসেরাতা শহরের এই দুই ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশটির দক্ষিণপন্থী কট্টরবাদী দলগুলো আসন্ন ৪ মার্চের নির্বাচনে এটাকে পুঁজি করতে মরিয়া হয়ে পড়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চতুর্থ বৃহত্তম শক্তিশালী দেশ এবং জোটের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সদস্যদেশটির নির্বাচন নিঃসন্দেহে ইইউ জোট রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অনেকটা উদার প্রকৃতির দেশটিতে ঐতিহাসিকভাবেই নানা জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করছে। ইতালির জনসংখ্যা ৬ কোটি ৬০ লাখ, যার মধ্যে অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এই অভিবাসীরা বৈধভাবে চাকরি করেন এবং রাজস্ব পরিশোধ করে দেশটিতে বসবাস করছেন। তবে ভূমধ্যসাগরের অপর পারের দেশ লিবিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আফ্রিকা ও এশিয়ার যুদ্ধপীড়িত ও দরিদ্র শরণার্থীরা সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে আসছেন। এই মুহূর্তে ইতালিতে এ ধরনের শরণার্থীর সংখ্যা ৬ লাখ।

ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, ইতালিতে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে রাজনীতি করার বিষয়টি একদম নতুন। গত কয়েক বছর ধরে ইতালির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে কোনোভাবেই অভিবাসী বা শরণার্থীদের দায়ী করা যায় না। অথচ দেশটির রক্ষণশীল দলগুলোও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর নির্বাচনে বিদেশি-বিদ্বেষী দলগুলোর সাফল্য দেখে এই হানাহানির রাজনীতিকে কাজে লাগাচ্ছে। ইতালির রাজনীতিতে মূলত তিনটি জোট ভোটযুদ্ধে সক্রিয়। ২০১৩ সালের নির্বাচনেও মূলত তিনটি জোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। জোটগুলো ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ও সমমনা দলগুলো, বেপে গ্রিলোর নেতৃত্বে রক্ষণশীল ফাইভ স্টার মুভমেন্ট এবং সিলভিও বেরলুসকোনির নেতৃত্বে রক্ষণশীল ফরোয়ার্ড ইতালি। এই দলগুলোর বাইরে বামপন্থী ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ মুভমেন্ট, রক্ষণশীল আঞ্চলিক দল নর্দান লিগ, বাম ঘেঁষা সিনাসর্তা ইতালি, লিবারেল পপুলার অ্যালায়েন্স এবং রক্ষণশীল ব্রাদার অব ইতালি দল। ছোট দলগুলোর সব সময় বড় সমমনা দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় যাওয়ার রেওয়াজ ইতালিতে রয়েছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বেপে গ্রিলোর নেতৃত্বে রক্ষণশীল ফাইভ স্টার মুভমেন্ট নির্বাচনে ২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে শক্তিশালী দল হতে যাচ্ছে। দলটি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে, ইউরো মুদ্রা জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। বেরলুসকোনির নেতৃত্বে রক্ষণশীল ফরোয়ার্ড ইতালি দলটির ১৬ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাত্তিও সালভানির নেতৃত্বে আরেক রক্ষণশীল দল লিগা নর্ডের ১৪ শতাংশ ও রক্ষণশীল ইউরোবিরোধী ব্রাদার ইতালি দলটির ৫ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সব মিলিয়ে রক্ষণশীল দলগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশ বা অধিক ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে উদার সামাজিক গণতান্ত্রিক ধাঁচের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজির ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং সমমনা প্রগতিশীল ও বাম দলগুলো মিলিয়ে ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

১৯৮৯ সালে বার্লিনের প্রাচীর পতনের পর থেকে ইউরোপের দেশে দেশে যে নিও লিবারেলিজম বা উদারনৈতিক রাজনীতির স্রোত বহমান ছিল, আপাতত তাতে ভাটা পড়েছে। জনগণের মৌলিক চাহিদার বাইরে যে আরও কিছু চাওয়া-পাওয়ার বিষয় রয়েছে, সে বিষয়গুলো উদার গণতান্ত্রিক দলগুলো অনুধাবন করতে পারেনি। নিজেদের ভুল সংশোধন না করে কট্টর রক্ষণশীলদের সমালোচনায় তারা বেশি সময় ব্যয় করেছে। উদারবাদীদের ভুল রাজনীতির কারণে এখন ইউরোপের অনেক দেশেই তারা কট্টরবাদীদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে নতুবা কট্টরবাদীদের মতো নতুন সংস্করণের রাজনীতি গ্রহণ করছে।

ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার পর ইতালিতে উদারনৈতিক না কট্টরবাদী-কারা ক্ষমতায় আসছে, তা দেখা যাবে আগামী ৪ মার্চের নির্বাচনে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি
[email protected]