অভিভাবকেরা একটু দায়িত্বশীল হোন

শিশু নির্যাতন
শিশু নির্যাতন

তিন বছরের জোনাকি মারা গেছে গত শুক্রবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ফুটফুটে মেয়েটির। না, সে নিজে কীটনাশক খায়নি। কীটনাশক কী বস্তু, তা তার জানা ছিল না। কাজেই তার নিজে খাওয়ার প্রশ্নই নেই। তাকে কীটনাশক খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। জোনাকির বাবা আবুল হোসেন কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার আগে মেয়েকেও কীটনাশক খাইয়ে দেন। খবরটি পড়ে স্তম্ভিত হই। এ কেমন বাবা? নিজে মারা যাবেন বলে মেয়েকেও মেরে ফেলতে হবে?

প্রথম আলোর অনলাইনে গত শনিবার এই হৃদয়বিদারক খবরটি প্রকাশিত হয়। খবর অনুযায়ী, সপ্তাহখানেক আগে স্ত্রী পাপিয়ার সঙ্গে আবুল হোসেনের ঝগড়া হয়। ঝগড়ার জেরে পাপিয়া মেয়েকে ফেলে রেখেই বাপের বাড়ি চলে যান। আবুল হোসেন স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু স্ত্রী জানিয়ে দেন তিনি আসবেন না।

এরপর তিনি জোনাকিকে স্ত্রীর কাছে রেখে আসেন। কিন্তু তাকে ফেরত পাঠানো হয়। এরপরই আবুল হোসেন মেয়েকে কীটনাশক খাওয়ান এবং নিজে কীটনাশক খান। গুরুতর অবস্থায় দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর জোনাকি মারা যায়। আর চিকিৎসকদের চেষ্টায় বেঁচে যান আবুল হোসেন।

শুধু জোনাকি নয়, তার মতো আরও অনেক শিশু এ ধরনের নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার হয়েছে। যেমন, ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সোনিয়া আক্তার নামে এক নারী তাঁর ৪০ দিন বয়সী কন্যাশিশুকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, সোনিয়ার সংসারে অর্থনৈতিক অভাবের কারণে অশান্তি লেগেই থাকত। তাই তাঁর এই আত্মহননের সিদ্ধান্ত।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর দারুসসালাম থানার দিয়াবাড়ি এলাকায় এক নারী স্বামীর সঙ্গে কলহের জেরে নিজের তিন সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করেন, তারপর গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২০১৫ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে স্বামীর অনৈতিক সম্পর্কের কারণে হতাশ এক স্ত্রী তাঁর পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে হত্যা করে বিষপানে আত্মহত্যা করেন।

অতীতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন এ রকম কয়েকজন জানিয়েছেন, তাঁরা বেঁচে না থাকলে সন্তানদের কী হবে এই ভেবে তাঁরা সন্তানদের আগে হত্যা করেন। কী ভয়ংকর ভাবনা! ভবিষ্যতে সন্তানেরা নিরাপদে থাকবে কি থাকবে না, এই ভেবে তাদের প্রাণই কেড়ে নেওয়া?

আবার কিছু বাবা-মা আছেন, সন্তানের ভালোমন্দ নিয়ে যাঁদের কোনো ভাবনাই নেই। নিজের সুখ-সুবিধা নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত। নিজের সুখের জন্য তাঁরা সন্তানদের অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে যান। যেমনটা করেছেন আফসানা খান (ছদ্মনাম)। আফসানার ছিল সুখের সংসার। স্বামী ভালো চাকরি করেন। নিজের বাড়ি, নিজের গাড়ি। ঘরে তিনটি ফুটফুটে সন্তান। কিন্তু একদিন তাঁর জীবনে আসে অন্য পুরুষ। প্রেম হয় তাঁর সঙ্গে।

আফসানা সিদ্ধান্ত নেন স্বামীর ঘর ছাড়ার। বাচ্চাদের সঙ্গে করে নিয়ে গেলে তো নতুন স্বামীর তা ভালো লাগবে না। তাই তাদের ফেলেই চলে যান তিনি। এদিকে আফসানার স্বামীও বসে থাকেননি। স্ত্রী চলে যাওয়ার ধাক্কা সামলে কয়েক মাস পরই আবার বিয়ে করেন। কিন্তু নতুন বউয়ের তো এসব বাচ্চা পছন্দ হচ্ছে না। অতএব, তাদের একজনকে পাঠানো হলো হোস্টেলে, একজনকে ফুফুর বাড়ি আর সবচেয়ে ছোটটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো অনাথ আশ্রমে। এ রকম ঘটনা আরও ঘটেছে।

একটি শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না। বাবা-মা তাকে পৃথিবীতে আনেন। এ জন্য তাদের প্রধান কর্তব্য হলো শিশুটিকে সঠিকভাবে লালন-পালন করা, তার নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকেই এ দায়িত্ব পালন করেন না। সন্তানকে পৃথিবীতে এনেই খালাস। এরপর কীভাবে শিশুটি বড় হবে, কী খাবে, তার অন্যান্য চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে, তা নিয়ে তাঁরা ভাবেন না।

ধিক্কার সেই সব বাবা-মাকে, যাঁরা নিজের সুখের জন্য সন্তানকে অবলীলায় ত্যাগ করতে পারেন, হত্যা করতে পারেন। যাঁরা বাবা-মা হয়েছেন আর ভবিষ্যতে বাবা-মা হবেন, তাঁদের বলছি, সন্তান হেলাফেলার জিনিস নয়। যেহেতু আপনি তাদের পৃথিবীতে এনেছেন, তাদের ভালো-মন্দ সবই দেখতে হবে। তাদের সঠিকভাবে মানুষ করা, সুশিক্ষা দেওয়া আপনার কর্তব্য।

জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট আসবে। পরিস্থিতি সব সময় অনুকূলে থাকবে না। কিন্তু তার জন্য সন্তানদের ফেলে চলে যাওয়া, তাদের কষ্ট দেওয়া, হত্যা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একটু দায়িত্বশীল হোন। যাদের পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, তাদের পৃথিবীর আলো-বাতাস ভালোভাবে উপভোগ করতে দিন। তাদের যত্ন করুন। দেখবেন, তারাই একদিন আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে উঠেছে।

রোকেয়া রহমান: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক