অনাবদ্ধ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং

স্টিফেন হকিং
স্টিফেন হকিং

আইনস্টাইন ৭৬ বছর বেঁচে ছিলেন। স্টিফেন হকিংও বাঁচলেন ৭৬ বছর। যদিও বহু আগে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, হকিংয়ের যে মোটর নিউরনের রোগ, তাতে তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না। তবু তিনি বেঁচে ছিলেন। উপহার দিয়েছেন বিজ্ঞানের দিগন্তসীমার প্রপঞ্চ, ব্যাখ্যা করেছেন মহাবিশ্বের জটিল গঠন। এই দুটি কাজ দিয়েই তিনি প্রমাণ করেছেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মানসিক উৎকর্ষ সাধনে বাধা নয়। 

বিজ্ঞানজগতে হকিংয়ের আবির্ভাব হয়েছে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার হাত ধরে ১৯৬০-এর দশকে। সেই সময়ে বিজ্ঞানীরা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে তত মাথা ঘামাতেন না, যত ঘামাতেন কণা পদার্থবিদ্যা, কোয়ান্টাম তড়িৎ বলবিদ্যা কিংবা কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব নিয়ে। সাধারণ আপেক্ষিকতা নতুন জীবন পায় দুটি বড় পর্যবেক্ষণগত আবিষ্কার ও কিছু তাত্ত্বিক অগ্রগতির ফলে। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মারটেন স্মিড মহাকাশে অতি উজ্জ্বল কোয়াজার (এখন আমরা জানি, এগুলো কিছু গ্যালাক্সির শক্তিশালী কেন্দ্র) ও ১৯৬৪ সালে উইলসন ও পেনজিয়াস মহাজাগতিক বিকিরণ (মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড) আবিষ্কার করেন। 

বিগ ব্যাং মডেলে মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে এ রকম বিকিরণের একটা ভাবীকথন ছিল। প্রায় একই সময়ে নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী রয় কের কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) জন্য আইনস্টাইনের জটিল সমীকরণের একটি সমাধান বের করেন এবং ইংরেজ রজার পেনরোজ কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে স্থান-কালের চরম বক্রতায় অসীম ঘনত্ব সৃষ্টি হবে, সেটা প্রমাণ করেন। এই সব কটি আবিষ্কারেই সাধারণ আপেক্ষিকতার প্রয়োগ আছে। জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা তখন একটা নতুন অঙ্গনে প্রবেশ করল। সেই নতুন সময়ে, ৬০-এর দশকে হকিং তাঁর পিএইচডি থিসিস লেখেন। সেখানে তিনি মহাবিশ্বের উষালগ্নে সমসত্ত্ব বস্তু-ঘনত্ব থেকে পৃথক পৃথক গ্যালাক্সি সৃষ্টির সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেন। মহাকর্ষীয় তরঙ্গপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করেন। এই দুটি বিষয়ই বর্তমান মহাজাগতিক বিজ্ঞানের গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ববহ। ওই সময় থেকেই পেনরোজের সঙ্গে হকিংয়ের বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা শুরু হয় এবং এই দুজনে মিলে পরবর্তী ১০ বছরে কৃষ্ণগহ্বর বিজ্ঞানকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৯৮১ সালে আমি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছিলাম। আমাদের জ্যোতির্বিদ্যা ইনস্টিটিউটে স্টিফেন হকিং একটা সেমিনারে আসেন। তখনো তিনি বিড়বিড় করে হলেও কিছুটা কথা বলতে পারতেন। সেই কথা বোঝার সামর্থ্য একমাত্র যে ছাত্রকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন, শুধু তারই ছিল। সেই ছাত্র ঝুঁকে পড়ে হকিংয়ের কথা শুনে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করছিল এবং বোর্ডে চক দিয়ে কিছু লিখছিল। ওই বক্তৃতায় বোর্ডে একটি সাদা চক্র (যা কিনা কৃষ্ণগহ্বরকে বোঝাচ্ছিল) ছাড়া আর কিছু আমার মনে নেই। এর আগে ১৯৭৩ সালে হকিং মস্কো এসেছিলেন এবং বিখ্যাত সোভিয়েত বিজ্ঞানী ইয়াকভ জেলদোভিচ ও আলেক্সেই স্তারোবিনস্কির সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বর-সংক্রান্ত আলোচনার পর তিনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও কোয়ান্টাম মহাকর্ষ নিয়ে গবেষণায় আকৃষ্ট হন। জেলদোভিচ ও স্তারোবিনস্কি সেই সময়েই একটি ঘূর্ণনশীল কৃষ্ণগহ্বর থেকে যে কোয়ান্টাম প্রক্রিয়ায় বিকিরণ বের হতে পারে, সেটার প্রস্তাব করেছিলেন। যে কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ দিয়ে হকিং বিখ্যাত, সেই বিজ্ঞানে এই দুই রুশ/সোভিয়েত বিজ্ঞানীর অবদান অনস্বীকার্য। যত দূর মনে পড়ে, জেলদোভিচ ১৯৮১-এর সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন। এরপর ১৯৮৫ সালে জীবন বাঁচাতে গিয়ে হকিংকে গলায় অপারেশন করাতে হয়, ফলে তিনি বাক্শক্তি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেন।
 
এখানে কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ সম্পর্কে দু-একটা কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমরা জানি যে জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে একটি বিশাল ভরের তারার কেন্দ্রের দিকে পতন হয় এবং একটি বিন্দুর থেকেও কম পরিসরে অত বড় তারাটির ভর সীমাবদ্ধ হয়ে গেলে তার ঘনত্ব অসীম হয়ে যায়। সেই অসীম ঘনত্ব জিনিসটা কী, সেটা আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল। কিন্তু আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বলে, ওই রকম অতি ঘন বস্তু (সিঙ্গুলারিটি) তার চারপাশের স্থান-কালের কন্টিনুম বা ‘চাদরকে’ এমনভাবে বাঁকা করে ফেলে যে সেই ‘চাদর’ ওই বস্তুকে ঢেকে দেয় এবং আমরা সেটার ভেতরে কী ঘটছে, তা আর জানতে পারি না। এর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এমন যে ওই গহ্বর থেকে আলোও বিকিরিত হতে পারে না। কিন্তু হকিং দেখালেন কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোয়ান্টাম প্রক্রিয়ায় আলো (এবং নিউট্রিনো কণা) বের হতে পারে, কৃষ্ণগহ্বর অত কৃষ্ণ নয়। 

কিন্তু এই বিকিরণের মাত্রা এতই কম যে আমাদের বর্তমান দুরবিন দিয়ে সেটি নিরূপণ করা যাবে না। তবে হকিংয়ের হিসাব অনুযায়ী, কৃষ্ণগহ্বর যতই বিকিরণ করবে, ততই তার ভর কমবে এবং শেষাবধি সেটি একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যাবে। মুশকিল হলো, একটি এক সৌরীয় ভরের কৃষ্ণগহ্বর বিস্ফোরিত হতে কয়েক হাজার কোটি বছর লাগবে, যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের বয়স ১ হাজার ৪০০ কোটি বছরের মতো। তবে যদি কৃষ্ণগহ্বরের ভর খুবই কম হয়, মাউন্ট এভারেস্ট বা তার থেকেও কম ভরের, তবে সেগুলোর বিস্ফোরণের জন্য অত বছর অপেক্ষা করতে হবে না। ১৯৭০-এর দশকে অনেক কসমোলজিস্ট মনে করতেন, মহাবিশ্বের শুরুতে ছোট ভরের ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে এবং সেগুলো যদি ইতিমধ্যে বিস্ফোরিত হয়ে যায়, তবে তাদের আলো-মূলত গামা রশ্মি-আমাদের এখন দেখতে পাওয়ার কথা। 

আমরা, গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদেরা, ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে মহাকাশে গামা রশ্মি বিস্ফোরণ অবলোকন করছিলাম। সেই বিস্ফোরণের উৎস তখন অজানা ছিল। কিন্তু সেটা যে হকিংয়ের কৃষ্ণগহ্বর বিস্ফোরণ নয়, সেটা প্রথমেই বোঝা গিয়েছিল। এর কারণ, সেই গামা রশ্মির শক্তির চিহ্ন কৃষ্ণগহ্বর থেকে যে গামা রশ্মি আশা করা গিয়েছিল, সে রকম নয়। বর্তমানে প্রাচীন ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর থেকে সংকেত পাওয়ার আশা বিজ্ঞানীরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। আর গামা রশ্মি বিস্ফোরণের উৎস হিসেবে জ্যোতির্বিদেরা দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষ কিংবা একটি অতি বিশাল তারার সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরণকে নির্ধারণ করেছেন। 

হুইলচেয়ারে আবদ্ধ হয়ে হকিংয়ের মস্তিষ্ক মহাজগতে বিচরণ করে, এমন একটি রোমান্টিক ভাবনা মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। বিজ্ঞানকে বোধগম্যভাবে সাধারণের কাছে নিয়ে আসার জন্যও মানুষ তাঁকে চিনেছিল। আজকের সামাজিক মাধ্যমের উত্থানও এই পরিচিতিকে বিস্তৃত করেছে। একই সঙ্গে অনেকের একটি ধারণা হয়েছে যে আইনস্টাইনের একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরি হলেন হকিং। কিন্তু তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের প্রাসাদগঠন একটা দুরূহ প্রক্রিয়া। সেই প্রাসাদের সূক্ষ্ম কারুকাজে হকিং যেমন হাত লাগিয়েছিলেন, তেমনই জটিল নকশা এঁকেছেন রজার পেনরোজ, স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, এডওয়ার্ড উইটন, প্রয়াত ইয়াকভ জেলদোভিচ, আর্চিবাল্ড হুইলার। কয়েকটিমাত্র নাম বললাম। এই প্রাসাদের নিপুণ শিল্পীর তালিকা দীর্ঘ। তবু তাঁদের মধ্যে হকিং বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছেন। কারণ, তিনি পৃথিবীর মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

দীপেন ভট্টাচার্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইড কলেজের অধ্যাপক ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ