কোটা সংস্কারের দাবি যৌক্তিক

আকবর আলি খান
আকবর আলি খান
>কোটা সংস্কারের দাবিকে যৌক্তিক বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান। প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর এ মত জানান। তিনি বলেন, এ দাবির পেছনে যুক্তি থাকার কারণেই নানা বিভক্তি সত্ত্বেও নাগরিক সমাজের মধ্যে এ নিয়ে মতৈক্য রয়েছে। সাক্ষাৎকারে তিনি বিদ্যমান জেলা কোটা পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধার কোটা পদ্ধতিও তিনি সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের পটভূমিতে তাঁর এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া।

প্রথম আলো: শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলনের দাবিটি যৌক্তিক?
আকবর আলি খান: সরকারি চাকরি বা বিসিএসের মাধ্যমে চাকরি পেতে প্রস্তুতি, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও ফলাফলের জন্য অপেক্ষা-সব মিলিয়ে দুই থেকে আড়াই বছর সময় লাগে। একজন চাকরিপ্রত্যাশী যদি এত সময় ব্যয় করার পর দেখে যে তার চাকরি হয়নি এবং এর পেছনে কোটা একটি বড় কারণ, তখন অসন্তোষ খুবই স্বাভাবিক। এমনিতেই আমরা দেখছি যে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে আসতে চাইছে না। এরপর যদি বিষয়টি এতটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তাহলে তো ক্ষোভ-বিক্ষোভ খুবই স্বাভাবিক।

প্রথম আলো: নাগরিক সমাজ থেকেও তো কোটা সংস্কারের পক্ষে মত এসেছে...
আকবর আলি খান: আমাদের নাগরিক সমাজের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও আমরা দেখছি যে এ ক্ষেত্রে তা নেই। সবাই বলছেন, কোটা ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নানা দল-মতে বিভক্ত হলেও তাঁরাও এর সংস্কার চান।

প্রথম আলো: কোটার হার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। নানা জন নানা মত ও প্রস্তাব তুলে ধরছেন। কত শতাংশ কোটাকে আপনি যৌক্তিক বলে মনে করেন?
আকবর আলি খান: দেখুন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা অনুসরণ করা হবে, আমাদের সংবিধান অনুসারে এটাই মূল নীতি। ব্যতিক্রম করা যেতে পারে শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। মূলনীতির চেয়ে তো ব্যতিক্রম কখনো বেশি হতে পারে না। এমনকি সমান সমান রাখলেও তা ৫০ ভাগের বেশি হতে পারে না। সে ক্ষেত্রেও ৫ শতাংশ এমনিতেই কমাতে হয়।

প্রথম আলো: ৫০ ভাগ কোটা কি যৌক্তিক?
আকবর আলি খান: ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন কোটার প্রবর্তন করেন, দেশে তখন ১৭টি জেলা। জেলা, মুক্তিযোদ্ধা ও মেধা-সব মিলিয়ে তখন কোটার সংখ্যা ছিল মোট ৩৫ টি। এখন ৬৪ জেলার কোটা, নারী কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, উপজাতি কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, মেধা কোটা-এসব যোগ করলে মোট কোটার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৮ টি। আমাদের এখানকার পদ্ধতিটি খুব জটিল, যাকে বলা হয় কোটা অন কোটা পদ্ধতি। কোনো চাকরিতে পদের সংখ্যা যদি হয় ৫০ টি, তাকে তো ২৫৮টি কোটায় ভাগ করার সুযোগ নেই। ফলে দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে। পৃথিবীর কোথাও এত বেশি কোটার সংখ্যা নেই। যখন জেলা কোটা করা হয়, তখন এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে ১০-১৫ বছরের মধ্যে তা উঠে যাবে। কারণ, তখন এই কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করা হয়েছিল, সেই বিরোধের বিরোধিতা করে নোট অব ডিসেন্টে তৎকালীন সংস্থাপনসচিব মাহবুবুজ্জামান লিখেছিলেন যে এটা একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা।

প্রথম আলো: আপনি কি জেলা কোটা উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে?
আকবর আলি খান: আমি মনে করি, জেলা কোটা এখন উঠিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলেই কোটার সংখ্যা ২৫৮টি থেকে এক লাফে ৩৮-এ নেমে আসবে। আমরা এটা কার্যকর করে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে মূল্যায়ন করে দেখতে পারি।

প্রথম আলো: জেলা কোটাকে কেন দরকারি মনে করছেন না?
আকবর আলি খান: দেখুন, বাংলাদেশে একসময় পদ্মা নদী পার হওয়া কঠিন কাজ ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিচ্ছিন্ন ছিল। নানা অঞ্চলে শিক্ষায় বৈষম্য ছিল। এখন যমুনা সেতু হয়েছে, পদ্মা সেতু হচ্ছে। শিক্ষায় আগের বৈষম্য অনেক কেটে গেছে। আমি বিসিএসের তিন বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখেছি, একসময়কার কুমিল্লার মতো শিক্ষায় অগ্রসর অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলের লোকজন বেশি চাকরি পেয়েছেন।

প্রথম আলো: বাকি কোটাগুলো?
আকবর আলি খান: নারী, মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি ও প্রতিবন্ধী-এসব কোটা থাকা উচিত।

প্রথম আলো: সেগুলোর কি কোনো সংস্কার প্রয়োজন?
আকবর আলি খান: মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার করা উচিত। সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধা কোটার কোনো বিধান নেই। সংবিধানে আছে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে পঙ্গু হয়েছেন। এসব কারণে তাঁদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা তাঁদের যথাযথ পুনর্বাসন করতে পারিনি। সেসব বিবেচনায় তাঁদের সন্তানদের জন্য কোটা রাখা যায়। তবে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট থাকলেই তা কার্যকর হওয়া ঠিক নয়। যাঁরা অনগ্রসর বা যুদ্ধাহত, শুধু তাঁদের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এমন ব্যবস্থা নেওয়া হলে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি কমে যাবে। ভারতে দলিত শ্রেণির জন্য কোটা রয়েছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে দলিত সম্প্রদায়ের সবাই এই সুবিধা পাচ্ছে। কোনো দলিত পরিবারের কেউ কোটায় চাকরি পেলে তাঁর সন্তান আর সে সুযোগ পাবে না। ভারতে কার্যকর এ ধরনের বিধানকে বলা হয় ‘ক্রিমি লেয়ার’। আমাদের দেশেও এ ধরনের বিধান করা যায়। এটি করা গেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আর খুব বেশি প্রার্থী পাওয়া যাবে না। তখন সেগুলো মেধা কোটা থেকে পূরণ করা যাবে।

প্রথম আলো: কোটার কারণে মেধা উপেক্ষিত হওয়ার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
আকবর আলি খান: কোটা কখনো কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এর মূল্যায়ন করতে হবে। যেমন, সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন আছে। কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী বিষয় নয়, বরং সুনির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য। সরকার নিয়মিত সে মেয়াদ বাড়াচ্ছে। সরকারি চাকরিতে কোটা অন্তত পাঁচ বছর পরপর মূল্যায়ন করে সংস্কার করা উচিত। আমরা যদি মূল্যায়ন করে দেখি যে নারীরা মেধার ভিত্তিতেই জায়গা করে নিতে পারছেন, তাহলে তো সেই কোটা রাখার কোনো যুক্তি থাকবে না। আবার যদি মনে হয় বর্তমান কোটায় কাজ হচ্ছে না, তাহলে সেটা বাড়ানোও যেতে পারে। তবে একটি ব্যাপার আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে তিনবার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছিল। তিনটিই কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে প্রথম কমিশনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে এবং শেষেরটি শেখ হাসিনার আমলে।