বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের সাফল্য

২০ বছর ধরে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এসিএম-আইসিপিসির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের প্রথম অংশগ্রহণ শুরু হয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। আমাদের স্কুলপড়ুয়া ছাত্ররা শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে। তারপর ১৯৯৭ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিংয়ের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার সূচনা হয়। সেই প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি করে দল যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আটলান্টা শহরে অংশগ্রহণ করতে যায়। ৫৪ দলের সেই প্রতিযোগিতায় বুয়েট ২৪ তম স্থান দখল করে। এতে আমাদের মন খুব খারাপ হয়। তখন জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার আমাদের জানালেন যে খারাপ করলেও আমাদের দল সুবিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একই স্থান দখল করেছে।

এরপর প্রশিকা ও ডেইলি স্টার পত্রিকার আয়োজনে ১৯৯৮ সালের ৬ আগস্ট তৎকালীন শেরাটন হোটেলে জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এ প্রতিযোগিতার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মতিন পাটোয়ারী ও জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার। এরপর আমাদের ছাত্ররা প্রোগ্রামিংয়ের অনলাইন সাইটে সমস্যা সমাধানের তাক লাগানো সাফল্যে ভ্যালাদলিদ সাইটের সর্বোচ্চ ২৫টি স্থানের মধ্যে ১৮টিই দখল করে ফেলে। তারপর বুয়েটের ছাত্ররা পরপর ১৭ বার এসিএম-আইসিপিসি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। এ ছাড়া ঢাকা, নর্থ সাউথ, এআইইউবি, ইস্ট ওয়েস্ট, জাহাঙ্গীরনগর ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডো শহরে অনুষ্ঠিত ৬০ দলের প্রতিযোগিতায় বুয়েটের পাপ্পানা, মুস্তাক ও ফেরদৌসের দল এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, বার্কলের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলোকে পেছনে ফেলে একাদশ স্থান দখল করে।

এখন আমাদের দেশে নিয়মিতভাবে সরকারের অর্থায়নে জাতীয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসাহে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা আয়োজনের সব দক্ষতা আমাদের আছে। আমাদের দেশের তরুণ বিচারক ও সমস্যা রচয়িতারা পার্শ্ববর্তী দেশসমূহেও তাদের সাহায্যের হাত নিয়মিতভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের রয়েছেন শাহরিয়ার মঞ্জুর, যিনি ২০০৩ সাল থেকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের বিচারক এবং সারা পৃথিবীর মেধাবীতম ছাত্রদের লেখা প্রোগ্রামের শুদ্ধতা যাচাই করেন। সারা এশিয়ার মধ্যে তিনিই একমাত্র এই দুর্লভ সম্মানে ভূষিত।

এখন আমাদের ছাত্ররা মার্কিন মুল্লুকে গিয়েও সেখানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রোগ্রামিংয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে অনেক সুনাম অর্জন করছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে স্থান করে নেওয়াটা অত্যন্ত কঠিন। ঢাকা শহরের বাইরে থেকেও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। তারা ২০১১ সাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিবছর এই মর্যাদাকর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে। ১৯৯৯ সালে আমাদের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কানপুর সাইটের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। ওই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) চ্যাম্পিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রানার্সআপ হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।

মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতার এই সূচনা আমরা গণিত, ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নের মতো বিষয়েও বিস্তৃত করেছি; যার ফলাফলও ঈর্ষণীয়। আমাদের গণিত দল গত বছর ব্রাজিলে ২৬ তম স্থান দখল করেছে, পক্ষান্তরে ভারতের দল পেয়েছে ৫২ তম স্থান। ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে আমাদের ছাত্ররা যথেষ্ট খারাপ করার পরও চারটি ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছে, আর ভারত পেয়েছে তিনটি। পদার্থবিজ্ঞানের অলিম্পিয়াডেও আমাদের ছেলেরা রৌপ্যপদক পেয়েছে। ২০০৯ সালে আইসিপিসি চ্যালেঞ্জে বুয়েটের দল স্টকহোম শহর থেকে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিল।

এ বছর এসিএম-আইসিপিসি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে চীনের বেইজিং শহরে। ১৯ এপ্রিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে। বিভিন্ন দেশের ১৪০টি দল এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে বুয়েট ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিযোগিতায় দুটি দলই র‍্যাংক পেয়েছে। ভারতের কেবল আইআইআইটি হায়দরাবাদ পাঁচটি সমস্যার সমাধান করে আমাদের থেকে এগিয়ে। ভারতের বাকি আটটি দলই পেনাল্টি সময়ের ব্যবধানে বুয়েটের থেকে পেছনে। এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি। দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে একই শহরের মস্কো ইনস্টিটিউট অব ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি।

জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার এবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করছেন একটি লক্ষ্য নিয়ে, তা হলো বাংলাদেশে এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ জাতির জন্য এর থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য আর কোনো লক্ষ্যই থাকতে পারে না। তা-ও আবার চেষ্টা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে। জামিলুর রেজা স্যারের নেতৃত্বে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক একাধিকবার আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। অত্যন্ত সুন্দরভাবে করা এসব আয়োজন আইসিপিসির এশিয়াবিষয়ক পরিচালক অধ্যাপক হোয়াংকে অনেক মুগ্ধ করেছে। আমার ধারণা, প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের সুবর্ণ সুযোগ বাংলাদেশের হাতে এসে যাচ্ছে। আইসিপিসির কর্ণধারেরা সক্রিয়ভাবে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের প্রস্তাবটি বিবেচনা করছেন।

এ-যাবৎকালে আমাদের সবচেয়ে ভালো ফলাফল ২০০০ সালে অরল্যান্ডো শহরে অনুষ্ঠিত ২৪ তম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বুয়েট দলের একাদশ স্থান লাভ, ২০১৪ সালে বুয়েট দলের ১৯ তম স্থান দখল, ১৯৯৮ সালে প্রথম অংশগ্রহণে বুয়েট দলের ২৪ তম স্থান লাভ। আমরা আমাদের সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতিকে আরও অনেক ভালো ফলাফল দিতে চাই। এ জন্য অনেক বেশি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, আমাদের ছাত্রদের অনুশীলনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

২০২১ সালে এই প্রতিযোগিতায় যারা অংশগ্রহণ করবে, তারা নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র অথবা আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। তাদের এখন থেকেই অনুশীলনের মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে আমরা দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই মহা মর্যাদাকর প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করে গোটা জাতিকে উজ্জীবিত করতে পারি। এ জন্য নিয়মিতভাবে জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, জাতীয় ইনফরমেটিকস প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে এবং সেখানে বিজয়ীদের জন্য আকর্ষণীয় প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে এখন থেকেই আটঘাট বেঁধে নেমে পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে, এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কাজ এখনই হাতে নিতে হবে।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অধ্যাপক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস