বাংলাদেশ যা শিখতে পারে

মালয়েশিয়ার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের নেতা মাহাথির মোহাম্মদ
মালয়েশিয়ার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের নেতা মাহাথির মোহাম্মদ

৯ মে মালয়েশিয়ায় একটি ঐতিহাসিক ব্যালট বিপ্লবে নেতৃত্ব দিলেন ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কিংবদন্তি নেতা, মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ। তাঁকে ‘আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ, তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণেই এককালীন পশ্চাৎপদ দেশ মালয়েশিয়া উন্নত দেশের কাতারে স্থান করে নিচ্ছে। তাঁর ‘ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি’ বিশ্বের জনগণের কাছে একটি অতুলনীয় জাতি গঠনমূলক পদক্ষেপ হিসেবে প্রশংসনীয় হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে সমাজের আয় পুনর্বণ্টনের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মাহাথির যেভাবে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী মালয়ীদের দ্রুত দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক আধুনিকায়নের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছেন, তা-ও উন্নয়ন চিন্তাধারায় একটি ‘নতুন প্যারাডাইম’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

‘বৈষম্য নিরসনমূলক প্রবৃদ্ধি কৌশল’ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির মাধ্যমে কাউকে বঞ্চিত না করেও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় তুলে আনা যায়। এই ‘ভিশনারি দর্শন’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মাহাথির যে মালয়েশিয়ানদের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন, তারই জাজ্বল্যমান প্রমাণ ৯ মের নির্বাচন, যেখানে ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের পর ৬০ বছর ধরে নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ‘বারিসান নেশিয়নাল’ জোটকে পরাজিত করে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট ‘পাকাতান হারাপান’ মালয়েশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে। ‘পাকাতান হারাপান’ কথাটির অর্থ ‘আশার জন্য ঐক্যজোট’। মালয়েশিয়ার ১ কোটি ৪৩ লাখ ভোটারের ৭৬ শতাংশ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। মোট ২২২টি সংসদীয় আসনের মধ্যে পাকাতান হারাপান পেয়েছে ১২১টি, বারিসান নেশিয়নাল পেয়েছে ৭৯টি। মাহাথির দাবি করেছেন, তাঁর জোট ইতিমধ্যেই ১৩৫ জন সংসদ সদস্যের সমর্থন পেয়েছে। ১০ মে মালয়েশিয়ার সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন মাহাথির।

অথচ বারিসান নেশিয়নাল জোটের প্রধান শরিক ইউনাইটেড মালয়াস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) ২০১৬ সাল পর্যন্ত মাহাথিরেরও দল ছিল। ১৯৮১ সালে ওই দল থেকেই মনোনীত হয়ে পরপর পাঁচবার নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা-উত্তর মালয়েশিয়ার ৬১ বছরের মধ্যে মাহাথির দীর্ঘ ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর স্বেচ্ছা-অবসরে গিয়েছিলেন ২০০৩ সালে। এবারের নির্বাচনে পর্যুদস্ত প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকও মালয়েশিয়ার ক্ষমতাধর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। মাহাথিরের হাত ধরেই তাঁর ভাবশিষ্য হিসেবে নাজিবের রাজনীতিতে আসা। নাজিবের পিতা তুন আবদুর রাজাক মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, নাজিবের চাচা তুন দাতুক অন ছিলেন তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। নাজিবের সৌভাগ্যের দরজাও খুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং মাহাথির।

১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে মাহাথিরের সম্ভাব্য উত্তরসূরি ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে মাহাথিরের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় কিছু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতিকে কেন্দ্র করে। ওই ঝগড়ার পেছনে মার্কিন দক্ষিণপন্থী মহল এবং ইহুদিবাদীদের (জায়োনিস্ট) উসকানি ছিল, আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানোই তাদের অ্যাজেন্ডা ছিল। আনোয়ারকে শায়েস্তা করার জন্য মাহাথির তাঁকে পদচ্যুত করেন, তাঁর বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার আদালতে সমকামিতার অভিযোগ আনা হয়। আনোয়ার বিরোধী নেতা হিসেবে মাহাথিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক ঝড় তোলার প্রয়াস নেন। মাহাথিরকে অজস্র নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হতে হয়, বিশেষত পাশ্চাত্যের জায়োনিস্ট-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলের। তাঁকে স্বৈরশাসক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের একজন সাহসী রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকার কারণে। প্রকৃতপক্ষে, এসব প্রচারণা মাহাথিরের জনপ্রিয়তা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল দেশে-বিদেশে।

২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়লেও বারিসান নেশিয়নালের নিয়ন্ত্রণ মাহাথিরের হাতেই ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ক্ষমতা ছাড়ার সময় মাহাথির প্রধানমন্ত্রীর পদটি যে আবদুল্লাহ বাদাবির হাতে অর্পণ করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে অবস্থান নিয়ে মাহাথিরই নাজিবকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নাজিব মাহাথিরের আস্থা হারালেন দুর্নীতির কারণে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুতর অভিযোগ ওয়ানএমডিবি (ওয়ান মালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট বেরহাদ) নামের সরকারি বিনিয়োগ সংস্থা থেকে নাজিব ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের ৪৫০ কোটি ডলার আত্মসাতের ব্যাপারটি সম্পর্কে, যার মধ্যে ৭০ কোটি ডলার নাজিবের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। নাজিব ওই অর্থ তাঁকে সৌদি আরব সরকার উপহার দিয়েছে বলে দাবি করে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বারিসান নেশিয়নাল ২২২ সদস্যপদের মধ্যে ১৩৩ পদে জিতে সরকার গঠন করে, দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নাজিব। কিন্তু নির্বাচনের পর দুর্নীতির অভিযোগ আরও জোরালো হয়। অন্যদিকে, অভিযোগ খণ্ডানোর অভিপ্রায়ে নাজিব নানা অপকৌশল নেওয়া সত্ত্বেও ২০১৫ সালে স্বয়ং মাহাথির দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নাজিবের পদত্যাগ দাবি করেন। নাজিব মাহাথিরের বিরুদ্ধে সরকারি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ শুরু করেন এবং তাঁকে নানাভাবে নাকাল করতে উঠেপড়ে লেগে যান। এমতাবস্থায় ২০১৬ সালে মাহাথির বারিসান নেশিয়নাল থেকে পদত্যাগ করে নতুন বিরোধী দল গঠন করে নাজিবের পতনে মাঠে নামেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মাহাথিরকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী জোট পাকাতান হারাপান থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদের প্রার্থী ঘোষণা করা হয় আনোয়ার ইব্রাহিমের সম্মতিতেই। বিনিময়ে মাহাথির অঙ্গীকার করেন তিনি নির্বাচিত হলে মালয়েশিয়ার সুলতানের কাছে আনোয়ারকে ক্ষমার সুপারিশ করবেন, যাতে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারেন। আপাতত আনোয়ারের স্ত্রী আজিজা মাহাথিরের মন্ত্রিসভায় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার নিযুক্ত হবেন।

মালয়েশিয়ার এই ব্যালট বিপ্লব থেকে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষণীয় হলো, মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত একটি দেশে পরিণত হয়েছে, শত প্রচার-প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও তা জনগণের মন থেকে মুছে ফেলা যায়নি। তিনি যখন ডাক দিলেন যে জীবনসায়াহ্নে তাঁর কিছু অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করার জন্য তাঁর স্বল্পকালের জন্য আরেকবার ক্ষমতায় যাওয়া প্রয়োজন, তখন জনগণ তাঁর আকুতিতে সাড়া দিয়েছে। শত দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও মাহাথিরের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৫ বছরেও কোনো অভিযোগ তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কোনো আদালতে প্রমাণ করতে পারেনি। আনোয়ারও পারেননি, নাজিবও পারেননি। তাঁর ছেলেকে অন্যায় ব্যবসায়িক সুবিধা দিয়েছেন বলে মাহাথিরের বিরুদ্ধে প্রচারণা এখনো জোরদার। কিন্তু জনগণ যে এসব অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁকেই ভালোবাসেন, তারই প্রমাণ এই ঐতিহাসিক বিজয়।

বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় শিক্ষা: বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার কোনোটিতেই ক্ষমতাসীন দল বা জোট পুনর্নির্বাচিত হয়নি, কারণ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের কারণে প্রতিবারই ক্ষমতাসীন সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিল। গত নয় বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনগুলোর সুফল ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে ঘরে তুলতে পারবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। আমার মতে, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে শেখ হাসিনার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার চাবিকাঠি ধারণ করছে দুর্নীত ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে তিনি যে সত্যিই আপসহীন, সেটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।

নির্বাচনের আগে যেটুকু সময় রয়েছে তার মধ্যে জনগণকে এই বার্তা পৌঁছে দিতেই হবে। তাহলে তাঁর আমলে অর্জিত অর্থনৈতিক সাফল্যকে জনগণ যথাযথভাবে হয়তো মূল্যায়ন করবে। তৃতীয় শিক্ষা: এবারও মালয়েশিয়ার নির্বাচনে জালিয়াতির বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন নাজিব। বিরোধীদের দমনেরও নানা ফন্দিফিকির শুরু করেছিলেন তিনি, সব এখন ভেস্তে গেছে। এখান থেকে মহাজোটেরও শিক্ষা নেওয়া উচিত, দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন দিয়ে জনগণের মন জয় করতে না পারলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চাণক্যনীতি আখেরে সফল হবে না। চতুর্থ এবং সর্বোত্তম শিক্ষা: অতীতের ভুলগুলো স্বীকার করে সংশোধনের অঙ্গীকার বিশ্বাসযোগ্যভাবে করতে পারলে তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

ড. মইনুল ইসলাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক