রোহিঙ্গা বিষয়ে আইসিসির উদ্যোগ

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার অভিযোগের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) অভিমত পাঠাতে বাংলাদেশকে অবশ্যই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে হবে। বাংলাদেশকে ১১ জুনের মধ্যে তার মতামতের গোপনীয়তা বজায় রাখার শর্তে ন্যায়বিচারের অনুকূলে মত পাঠানো উচিত হবে।

 সার্বিক বিচারে বাংলাদেশ যদি এখন আইসিসিতে যথাযথ মতামত দিতে ব্যর্থ হয় তবে তা হবে আত্মঘাতী। বাংলাদেশ যদি যথাযথ মতামত দিতে ব্যর্থ হয় তবে তার সুযোগ লুফে নেবে মিয়ানমার। আর বাংলাদেশের অনুকূলে সারা বিশ্বের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার-বিষয়ক যেসব সংগঠন সোচ্চার রয়েছে, তাদের ভেতরে হতাশা নেমে আসবে। সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হবে এটাই যে বাংলাদেশ সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের নিজেদের বসতভিটায় ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে চাপ দেওয়ার নৈতিক শক্তি হারাবে। এর আগে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ না বলার শর্ত মেনে মিয়ানমারের সুবিধা করে দিয়েছে। মিয়ানমারের শর্তে রাজি হওয়ার অল্প কিছুকাল পরেই আরসার সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলার অজুহাত দেখিয়ে বর্বরতা, হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। মিয়ানমার সরকার এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে বিবেচনা করে। রাখাইন রাজ্য থেকে আসা এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি বিবেচনা করার সরকারি নীতি পাল্টানোর কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসনের কার্যকর কোনো অগ্রগতি নেই। বরং নানা অজুহাতে মিয়ানমার সরকারের সময়ক্ষেপণের বিষয়টিই পরিষ্কার। এই চুক্তির দোহাই দিয়ে মিয়ানমার তার বড় অবরোধ আরোপ বা আইসিসির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চাপ থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই বাংলাদেশকে তাদের অপকূটনীতি রুখতে হবে।

 মিয়ানমারসহ তার মিত্ররা, যার মধ্যে বাংলাদেশেরও গুরুত্বপূর্ণ মিত্র থাকতে পারে, তাদের কাছে বাংলাদেশকে একটি মৌলিক পার্থক্য পরিষ্কার করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্রই ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের তদন্ত বা বিচার প্রতিহত করার কোনো প্রয়াসে যুক্ত হওয়ার এখতিয়ার বা অধিকার রাখে না। সুতরাং দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার সংকল্পে অবিচল থাকার সঙ্গে আইসিসি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকারও কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশ যেখানে নিজের দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচারে ভূমিকা রাখতে না পারলে তা দেশটির নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।

আইসিসিতে মত পাঠানো প্রশ্নে গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের জবাব আপাতত নেই। আমরা দেখছি, কী করা যায়।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অনানুষ্ঠানিকভাবে পেশাদারির ছাপ রাখা। সরকারের বাইরের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মতামত নেওয়া। প্রথম আলোর ইংরেজি অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন আইসিসিতে মত পাঠানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি: আইসিসির সুয়োমোটো উদ্যোগ নেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। তাই সংকটে আক্রান্ত বাংলাদেশের হ্যঁা বলাই উচিত হবে।

বাংলাদেশকে বুঝতে হবে, তার শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা বুঝতে পেরেই আইসিসি তাঁর চিঠিতে তাকে তার মতামত প্রদানের বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখার বিকল্প রেখেছেন। বাংলাদেশের উচিত হবে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তারা যে এমনি এমনি এই দেশে হাজির হয়নি এবং তারা যে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছে, সেসব তথ্য আইসিসির কাছে তুলে ধরা।