অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তি

গত সোমবার বাংলাদেশ স্টাডি ট্রাস্ট আয়োজিত ‘স্বপ্নপূরণের বাজেট, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির রূপরেখা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বাজেট বাস্তবায়ন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে যেসব কথা শোনালেন, তার প্রায় সবটাই হতাশাজনক। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যটি খুবই উদ্বেগজনক। তিনি বলেছেন, আমলাদের অসহযোগিতার কারণেই বাজেট বাস্তবায়নের হার কমছে। আগে বাজেটের ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হতো, এখন সেটি নেমে ৮০ শতাংশে এসেছে।

অর্থমন্ত্রী প্রতিবছর বিরাট অঙ্কের বাজেট প্রণয়ন করেন। কিন্তু অর্থবছরের শেষে গিয়ে দেখা যায়, সেই বাজেটের অনেকাংশই বাস্তবায়িত হয় না। অনেক সময় বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত পাঠাতে হয়। বাজেট বাস্তবায়ন একটি সমন্বিত প্রয়াস। সংশ্লিষ্ট সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকলে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজেট বাস্তবায়নে গতি আনতে অর্থমন্ত্রী যে উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালকদের (পিডি) নিয়ে একটি পুল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, গত দুই বছরেও তা কার্যকর করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী এ জন্য আমলাদের দায়ী করেছেন। তার পেছনে হয়তো কারণও আছে; বাজেট বাস্তবায়ন যত প্রলম্বিত হবে ততই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পোয়াবারো। প্রকল্পের মেয়াদের সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ানো যায়। দেশি-বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় তো বাড়ছেই। সেই সঙ্গে ছোট প্রকল্পগুলোর ব্যয়ও বেড়ে চলেছে।

অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে যে কঠিন সত্যটি বেরিয়ে এসেছে, তা হলো সরকারের নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে বিরাট ফারাক আছে। এই ফারাকটি ঘোচানোর দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা নেই। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর পরই অর্থমন্ত্রীর স্থান। তিনিই যদি বাজেট বাস্তবায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমলাদের কথা না শোনাতে পারেন, অন্য মন্ত্রীদের অবস্থা কী, তা সহজেই অনুমান করা যায়। বাজেট বাস্তবায়নের ধীরগতি ও কাজের মান নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হয়েছে। তখন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে হয়তো অর্থমন্ত্রীকে এভাবে আক্ষেপ করতে হতো না।

যেকোনো দেশের প্রশাসন পরিচালনায় পুরস্কার ও তিরস্কারের বিধান থাকতে হবে। যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় বসাতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে ধীরগতির জন্য যেসব সরকারি কর্মকর্তা দায়ী, অর্থমন্ত্রীর উচিত হবে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। সেই সঙ্গে আরও একটি বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

সংসদে বাজেট অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে যাতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের জন্য বরাদ্দ অর্থ ছাড় হয়, সেই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে। অনেক সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে অভিযোগ করা হয়, অর্থ ছাড় না হওয়ার কারণে তারা কাজ শুরু করতে পারছে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে কাজ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু অর্থই যদি ছাড় না হয় তারা কাজ শুরু করবে কীভাবে? সমস্যা দুদিক থেকেই আছে।

অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী দারিদ্র্য বিমোচনের হারও কমে যাওয়ার যে তথ্য দিয়েছেন, সেটাও উদ্বেগজনক। সরকার প্রথম দিকে দারিদ্র্য বিমোচন অন্যতম অগ্রাধিকার কর্মসূচি ঘোষণা করলেও হালে মনোযোগ কমেছে বলেই ধারণা করি। একই কথা প্রযোজ্য কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিষয়েও।

সব মিলিয়ে সরকারের শেষ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। গত ছয় বছরে বাজেটের আকার ছয় গুণ বেড়েছে। এটি আশার দিক। কিন্তু সেই বাজেট যদি বাস্তবায়নই না হয়, তাহলে বড় অঙ্কের বাজেটের সার্থকতা কী।