বাঘ ও মানুষের সহাবস্থান কি সম্ভব?

বাঘ শুধু মারেই না, মানুষকে খেয়েও ফেলে
বাঘ শুধু মারেই না, মানুষকে খেয়েও ফেলে


সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ি থেকে আমরা জানতে পারছি, আমাদের শহরবাসের ইতিহাস বেশ পুরোনো-হাজার বছরের বেশি। কিন্তু আমাদের প্রাচীন শহরগুলোর কোনোটাই খুব বড় বা বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছিল, এমন প্রমাণ এখনো মেলেনি। ফলে ২০০ বছর আগের বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলেও আপনি দেখবেন, জলাজঙ্গলাকীর্ণ একটি বনভূমি, যার কিছু কিছু অংশে বসতি আর খেতখোলার বিরতি আছে।

উনিশ শতকের ব্রিটিশ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের লেখাপত্রে এ এলাকার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবেন, দেশটি যখনই কিছুটা সমৃদ্ধ হয়েছে, যখন কিছুটা নগরের বিস্তার ঘটেছে, তখনই এক দখলকারীর হাত থেকে অন্য দখলকারীর হাতে পড়েছে। আর প্রতিবার হাতবদলের পরপরই দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভিক্ষে মানুষের আবাস উজাড় হয়েছে। জঙ্গল আবার ফিরে পেয়েছে তার হারানো এলাকা।

বৃষ্টিবহুল, উপমহাদেশের প্রধান নদীগুলোর মোহনার এলাকা হওয়ায় বাংলা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উর্বর এলাকা। আকারে ছোট হলেও এখানে তিন ধরনের বন গজিয়ে উঠেছে। শালের জঙ্গল, মিশ্র বৃষ্টিপাতের জঙ্গল আর ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। ফলে এ এলাকা পাখি, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর খনি হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ সিভিলিয়ানরা একবাক্যে বলেছেন, বাংলাদেশে এমন কোনো এলাকা ছিল না, যেখানে বাঘ ছিল না (হাতিয়া, সন্দ্বীপ বাদে)। সমগ্র বাংলাদেশের কৃষককে বাঘের সঙ্গে দেশ ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছে। সিভিলিয়ানদের বিবরণীতে পাওয়া যায়, ডোরাকাটা বাঘ সাধারণত খেতখোলা বা গ্রামীণ জঙ্গলে খুব একটা আসত না। এরা একটা নিরবচ্ছিন্ন বনভূমি পছন্দ করত। গ্রামীণ জঙ্গলে বাঘের স্থান দখল করে ছিল চিতাবাঘ।

তাহলে কি আমরা ধরে নেব, বাঘ আর মানুষ এ দেশে সহাবস্থান করত?

ইতিহাস কিন্তু সে কথা বলে না। উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ন এলাকায় আমরা দেখতে পাই, সেকালের মানুষ গর্ত করে রাত্রিবাসের জায়গা করেছিল। সহজেই ধরে নেওয়া যায়, এটা তারা ভেবেচিন্তে করেছিল বন্য প্রাণী, বিশেষ করে বাঘের হাত থেকে বাঁচতে।

মেডিকেল সার্জন জেমস টেলর লিখেছেন, এ দেশে বর্ষাকালে খুব বাঘের উপদ্রব হতো। জনসাধারণের গরু, মোষ তো মরতই, মানুষও মারা পড়ত বাঘের হাতে। বাঘের অত্যাচারে জনপদ উজাড় হয়েছে, এমন খবরও পাওয়া যায়। এর ফলে সরকারি রাজস্ব আদায় কমে যেত। বাঘ মারার জন্য মোগল আমল থেকেই একদল পেশাদার শিকারি নিয়োগ করা হতো সরকারি খরচায়।

বাঘ প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর প্রাণী হলেও বেড়ে ওঠার অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে তাকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হতে হয়। একই জঙ্গলে বাস করা বাঘের চেয়ে প্রখর ইন্দ্রিয়ের, কখনো কখনো দ্রুতগামী প্রাণী বাঘ শিকার করে শুধু দাঁত-নখ দিয়ে। বাঘ বন্দুক দিয়ে শিকার করে না, দৌড়ে ধরার মতো দূরপাল্লার দৌড়বিদের মতো তার দেহের গড়নও নয়। তার গন্ধ নেওয়ার ক্ষমতা খারাপ। এই অবস্থায় গড়ে প্রায় ২০ বার শিকারের পিছু নিয়ে মাত্র একবার সে সফল হয়। সফল হতে হলে শিকারের অনবধানে খুব কাছে গিয়ে তাকে চমকে দিতে হয়। শিকার চমক কাটিয়ে ওঠার আগেই বাঘকে শিকার ধরে ফেলতে হয়। সময়ের সামান্য হেরফেরে বাঘকে উপোস থাকতে হয়।

বাঘের মনস্তত্ত্ব এখনো মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে কিছু আচরণের খোঁজ পেয়েছে। মানুষখেকো বাঘ যদি জঙ্গলের আড়ালের মানুষের সাড়া পায় (মানুষের সাড়া পরিষ্কার বুঝতে পারলে), তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষটি মারা পড়ে। বাঘটি মানুষখেকো না হলে এবং লোকালয়ের আশপাশে চলাচলে কিছুটা অভিজ্ঞ হলে গাছপালার আড়াল নিয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে স্বাভাবিক ঔৎসুক্যে দেখতে চায়, কে এল।

কিন্তু জঙ্গলের পথে মানুষ ও বাঘের সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলে পরিস্থিতি অন্য রকম হয়-বাঘ কিছুতেই পিছু হটবে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। অপছন্দ হলে লেজ নাড়বে-ধমকানো হাঁক দেবে। বাচ্চা সঙ্গে থাকলে কিছুটা এগিয়ে আসবে, আবার পেছাবে। বাঘ তার মারা জীবজন্তু পাহারায় থাকলেও একই কাজ করবে। এসব ক্ষেত্রে মানুষের সংখ্যা এক বা দুই-বাঘ বিরক্ত হয়ে তাকে বা তাদের মেরেও ফেলতে পারে।

মানুষখেকোর চালচরিত্র একেবারে আলাদা। কোনোক্রমে চোখ পড়ে গেলেও সে সঙ্গে সঙ্গে আড়াল খুঁজে নেবে। তারপর নিজেকে আড়াল করে মানুষ ধরার চেষ্টা করবে।

গত শতকের প্রথম ভাগেই সুন্দরবন ছাড়া দেশের অধিকাংশ বনাঞ্চলের বাঘ শেষ হয়ে আসছিল। কিছু বাঘ টিকে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম আর সিলেট অঞ্চলে। সিলেটের তাহিরপুরের বিখ্যাত শিকারি আবদুর রহমান চৌধুরী লাউর অঞ্চলে জাদুকাটা নদীর ধারের জঙ্গলে শিকার করতেন। তিনি তাঁর তিনটি বইয়ে ওই এলাকার গবাদিপশুর ওপর বাঘের অত্যাচারের কথা জানিয়েছেন। মানুষখেকোর কথাও বলেছেন। সিলেটে মানুষখেকো বাঘকে ‘আদমখোরা’ বলা হতো। ওই এলাকায় বাঘের মানুষখেকো হয়ে ওঠার কারণ নির্ণয় করে তিনি লিখেছেন, দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক হতদরিদ্র মানুষ ধান কাটতে উত্তরে এসে জঙ্গলে বাস করতে শুরু করে, গবাদিপশু পোষে। জঙ্গলও সাফ করে কৃষিজমিতে পরিণত করে। ফলে এলাকা থেকে বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য শূকর, সাম্বার, বারশিঙ্গা, চিত্রা হরিণ, পারা হরিণ উত্তরের বনে সরে যায়। বাধ্য হয়ে বাঘ গরু-মোষ-ছাগল-কুকুর মারতে থাকে। গরু মারা বাঘের মানুষের ভয় কমে গেলে মানুষ মারা শুরু করে।

গত শতকের ষাটের দশকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধের ফলে এ এলাকার পাহাড়ি উপত্যকা জলপ্লাবিত হয়ে যায়। এসব উপত্যকাই পাহাড়ি জীবজন্তুর প্রধান খাদ্য সংস্থানের এলাকা। এই এলাকাগুলো প্লাবিত হলে পাহাড়ি বন্য প্রাণী ও স্থানীয় মানুষের আবাস সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে সংঘাত বেড়ে যায়।

আমাদের সুন্দরবন এলাকার আদিবাসীদের সঙ্গে জীবজন্তুর অবস্থান মোটেই সুখের নয়। জঙ্গলের ধার ঘেঁষে এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যার কোনো সদস্য কখনো না কখনো বাঘের হাতে বা সাপের হাতে প্রাণ হারায়নি। সাপের কামড়ে প্রাণ হারানোকে স্থানীয় লোকজন নিছক দৈব-দুর্বিপাক মনে করে। বাঘের হাতে প্রাণ হারানোকে মনে করে অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা। এটা সহজে কেউ মেনে নিতে পারে না। কারণ, বাঘ শুধু মারেই না, মানুষকে খেয়েও ফেলে। একটি সাপ দৈবক্রমে কাউকে কামড় দিয়েছে, সে সাপটি আর কাউকে কামড়াতে হন্যে হয়ে চেষ্টা করবে না। কিন্তু যে বাঘ একবার মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়েছে, সে তারপর থেকে মানুষ মারার চেষ্টা করেই চলবে; প্রতি সপ্তাহে একজন না একজন মানুষ মারবে। ফলে মানুষ লোকালয়ে সাপকে স্থান দিতে রাজি আছে, বাঘকে নয়।

মনে পড়ে ১৯৮৯ সালের কথা। বন বিভাগের সৌজন্যে সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্যে তিন মাস ছিলাম। কটকা নদীর পশ্চিম পাড়ে বন বিভাগের অফিস, রেস্টহাউস। নদীর পাড়ে দুটি ঘর তুলে থাকেন মাছ ব্যবসায়ী চিত্তবাবু, মুহুরীবাবু ও তাঁদের দলবল। ঘরগুলো মাটি থেকে ফুট চারেক উঁচু গেউয়ার বল্লির ওপর তোলা মাচাঘর। ঘরের সামনের দিকটায় খোলা মাচা। পেছনের ঘরটি এত ছোট যে সেখানে দু-তিনজনের বেশি মানুষের স্থানসংকুলান হওয়ার কথা নয়। চিত্তবাবু রাতে ঘুমান ওখানে আর বাইরের খোলা মাচায় ঘুমান জেলেরা। অন্য মাচাটিতে মুহুরীবাবু আর অন্য জেলেরা থাকেন।

বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে জেলেরা মাছ নিয়ে পৌঁছান চিত্তবাবুর ডিপোতে সকাল নয়টার দিকে। জঙ্গলে না গেলে আমি এই মাছ বেচাকেনার উৎসব দেখতে যেতাম। ক্রেতা চিত্তবাবু একা। তবে দাঁড়কাক, পাতিকাক, শঙ্খচিল, ভুবনচিল ফাঁক পেলেই এই মাছের স্তূপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এই প্রাণপ্রাচুর্য আর এক কাপ দুধছাড়া চা-এই অভয়ারণ্যে দারুণ তৃপ্তিকর বিনোদন।

প্রায়ই দেখতাম চিত্তবাবুর ঘরের পাশে বাঘের পায়ের তাজা ছাপ। বাঘ রাতে এ পথে হেঁটেছে, চিত্তবাবুর ঘর থেকে মাত্র চার-পাঁচ ফুট তফাত দিয়ে। এদিকটায় বাঘ আসে শিকারের খোঁজে। রেস্টহাউসের সামনে যে ফাঁকা মাঠের মতো এলাকাটা, সেখানে রাতে হরিণের দল আশ্রয় নেয়। আর এখানকার গেউয়াবনের আড়ে আড়ে বাঘ ঘোরে হরিণের আশায়। বাঘ ইচ্ছা করলেই চিত্তবাবুর বারান্দায় যাঁরা ঘুমান, তাঁদের যে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কখনো তা করেনি। চিত্তবাবুদের পর রামবাবুরা কটকায় ছিলেন, তাঁদের কাউকেও এখানে বাঘ আক্রমণ করেনি। চিত্তবাবুর ডিপোর উত্তরে যে মরা খালটির খাত, জেলেরা সেখানে ছোট ছোট নৌকায় রাত কাটান। বাঘ তাঁদেরও কখনো ধরার চেষ্টা করেনি।

কচিখালীতে সুপতি নদীর মোহনার পশ্চিম পাড়ে ১২৫টি ঘর তুলে হাজারখানেক জেলে বসবাস করতেন। তাঁদের একজন শুধু রাতের বেলা বন অফিসের পুকুর থেকে জল আনতে গিয়ে বাঘের থাবড়া খেয়েছিলেন। কিন্তু বাঘ কাউকে কোনো দিন ধরেছে বলে শুনিনি। কটকা মাঠে, কচিখালীর মাঠে প্রায় সারা বছর জঙ্গলের ভেতর ঘর তুলে শ দুয়েক ঘাসুড়ে ঘাস কাটেন। নিত্যদিন বাঘ তাঁদের দেখে, কিন্তু কখনো ধরার চেষ্টা করেনি।

আবার পশ্চিমের বাদার দৃশ্যপট ভিন্ন। সেখানে বন অফিস গরানের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখতে হয় বাঘের ভয়ে। বছর দশেক আগে নটাবেকী বন অফিসের কম্পাউন্ড থেকে বাঘ দুজন মানুষকে তুলে নিয়ে গেছে। রাতে জঙ্গলে থাকতে হলে লোকজন নৌকা বড় খালে নোঙর করে রাখেন। কেন পুবের বাদায় বাঘ মানুষের প্রতি সদাশয়, আর কেন পশ্চিমের বাদায় খড়্গহস্ত? এককথায় বলতে গেলে বলতে হবে, কটকা-কচিখালীতে বাঘের যথেষ্ট পরিমাণে খাবার আছে, কিন্তু পশ্চিমের বাদায় তা নেই।

অবশ্য এককথায় এই জিজ্ঞাসার সম্পূর্ণ উত্তর টানা বোকামি হবে। মূল কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। বাঘ সংরক্ষণের জন্য এই জিজ্ঞাসার উত্তর জানা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।

খসরু চৌধুরী: সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ এবং এ বিষয়ের লেখক