প্রবাসী নারী শ্রমিকের গল্পটা কেউ শুনবেন?

সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা নির্যাতনের শিকার কয়েকজন নারী। ছবি: প্রথম আলো
সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা নির্যাতনের শিকার কয়েকজন নারী। ছবি: প্রথম আলো

গরিবের বউ সমাজের সবার ভাবি—প্রচলিত এই তির্যক বাক্যটি ব্যক্তি, দেশ এবং বিশ্ব সবার বেলাতেই সত্য বলে মনে হয়। বাংলাদেশ ‘মধ্যম’ আয়ের দেশ। এহেন দেশ থেকে প্লেন ভাড়া দিয়ে, সৌদি ব্যাংক গ্যারন্টি জোগাড় করে (১০ হাজার রিয়াল ব্যাংকে জমা না থাকলে ব্যাংক গ্যারান্টি চিঠি ছাড় করে না) সরকারি দপ্তরে জমা দিয়ে তবে তারা নারী-শ্রমিক সংগ্রহ করে। এত কিছু যারা করে, তারা তো বিনিময়ে তাদের সঙ্গে যেকোনো কিছু করার দাবি রাখবেই। ভোগবাদী সমাজের এটাই খাসলত। খাসলতের কোনো পরিবর্তন নেই, এটা হার্ডডিস্কে লেপটে থাকে, সিলগালা হয়ে থাকে চরিত্রের ভাঁজে ভাঁজে। খাসলত এতটাই মজ্জাগত হয়ে যায় যে আইনকানুন, পরিবেশ, নীতিমালা, সমঝোতা স্মারক কোনো কিছু দিয়েই এটা বদলানো সম্ভব নয়। ২০১০ কি ২০০৯ সালে এক ইন্দোনেশীয় নারী শ্রমিক তাঁর সৌদি মালকিনের আর পরিবারের লোকজনের অত্যাচার-নির্যাতনের খাসলত বদলাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ছুরি চালিয়ে প্রতিকারের শেষ চেষ্টা করেন। মালকিনের দম বেরিয়ে যায়। সে দেশের আইনে খুনি হয়ে যান এই দেয়ালে পিঠ আটকে যাওয়া বোনটি। তাঁকে আর পাঁচটা খুনির মতো কতল করা হয়। দূতাবাস জানতে পারে অনেক পরে। সারা ইন্দোনেশিয়া উত্তাল হয়ে ওঠে। নারী গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার-অবিচারের কাহিনি একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে। সৌদিতে গৃহকর্মী সরবরাহকারী অপর দুই প্রধান দেশ শ্রীলঙ্কা আর ফিলিপাইনের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে প্রবাসী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন ও অন্যায়-অবিচার বন্ধের আওয়াজ তুলতে থাকে। একপর্যায়ে নেপালও যোগ দেয় এই জোটে।

ইন্দোনেশিয়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই সৌদি সরকার ২০১১ সালের ২ জুলাই ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপিনস থেকে গৃহকর্মী আনা নিষিদ্ধ করে এক ফরমান জারি করে। শ্রীলঙ্কাও বন্ধ করে দেয় নারী গৃহকর্মী সরবরাহের যাবতীয় কার্যক্রম। গতর না খাটিয়ে, দাঁতে কুটোটা না কেটে অভ্যস্ত সৌদি প্রজন্ম ভাবতে পারেনি সত্যি সত্যি গরিব দেশগুলো গৃহশ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেবে। এর মধ্যে খুব সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে তাদের জানিদোস্ত সৌদিদের বিষয়টি বিবেচনায় নিমরাজি হয় ফিলিপিনস। তারা সৌদি আরবে একটা সংসদীয় প্রতিনিধিদল পাঠায় সরেজমিনে পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য। ফিরে এসে তারা সংসদকে জানিয়ে দেয়, ‘আমরা আমাদের মেয়েদের ধর্ষিত বা নির্যাতিত হওয়ার জন্য সৌদি আরবে বিক্রি করতে পারি না।’

তাহলে আমরা কেন রাজি হলাম?
গৃহকর্মীর অভাবে চারদিকে হায় হায় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সৌদি সরকার বাংলাদেশকে নারী গৃহকর্মী প্রেরণের প্রস্তাব দেয়। এর আগে বাংলাদেশকে মোচড় দেওয়ার এক অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে। নতুন কোনো বাংলাদেশি (পুরুষ) শ্রমিকের নিয়োগও সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের একটা বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে এপ্রিলের মাঝে নয় সদস্যের এক সৌদি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ থেকে খাদ্দামা বা নারী শ্রমিক পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ‘মারহাবা মারহাবা’ বলে সে প্রস্তাব লুফে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দেন, প্রতি মাসে হাজার দশেক গৃহকর্মী নেবে সৌদি আরব। বাজারে রটিয়ে দেওয়া হয়, সৌদি শ্রমবাজার খুলে গেছে। নারী দিয়ে শুরু হবে, পুরুষেরাও যাবে পরে।

বাংলাদেশের এই ব্যাপক উৎসাহে চমৎকৃত সৌদিরা চুক্তি পাকা করার সময় সাফ জানিয়ে দেয় অন্য দেশের জন্য ১২০০/১৫০০ রিয়াল দিলেও বাংলাদেশের নারীদের জন্য ৮০০ রিয়ালের বেশি বেতন দিতে পারবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও প্রবাসীদের কল্যাণ ও অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুললে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ওরা যে এত বছর পর আমাদের জন্য দরজা খুলছে এটাই বড়, টাকা কমবেশি কোনো ব্যাপার নয়। তারপর ফিস ফিস করে জানিয়ে দেন গৃহকর্মী নেওয়ার পর অন্যান্য খাতেও পুরুষ কর্মীদের নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে সৌদি আরব। চুক্তির বাইরে এসব মন বোঝানো আশ্বাসের কি কোনো মূল্য আছে?Īচুক্তি সই হয়ে যায় ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে। সেদিন সৌদি উপশ্রমমন্ত্রী আহমদ আল ফাহাইদ বলেছিলেন, ‘গৃহকর্মীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য অধিকার রক্ষা করা হবে। কেউ আইন ভাঙলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কে কী ব্যবস্থা নিয়েছে, আমরা জানি না। এখন মাসে গড়ে ২০০ জন গৃহকর্মী প্রায় শরীরে ক্ষত আর মনে আতঙ্ক নিয়ে পালিয়ে আসেন। মানসিক ভারসাম্যের কড়িকাঠে ঝুলতে ঝুলতে তাঁরা দেশে ফিরছেন। তাঁদের অনেকেই ভর্তি হয়েছেন মানসিক হাসপাতালে।’

গায়ে কাঁটা দেওয়া সব শারীরিক নির্যাতনের কথা তাঁরা খোলা গলায় বলছেন। আমরা তাঁদের নিয়ে জবরদস্ত সংবাদ সম্মেলন করছি। হয়তোবা রমজানের পর মোমবাতি মানববন্ধন ইত্যাদিও হবে। কিন্তু কেউ কি আদালতে কড়া নাড়বেন? দেশীয় আদালতের পাশাপাশি হেগের আন্তর্জাতিক আদালত কিংবা জাতিসংঘের মানবধিকার কমিশন বা আইওএমের কাছে পেশ করবেন কোনো আরজি? নাকি বিশ্বাস করবেন, গরিবের বউ সবার ভাবি, চিমটিতেও কোনো নিষেধ নেই? নাকি বলবেন, সব বানানো কথা!

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।