চিংড়ি চাষ বিপন্ন করছে দক্ষিণের পরিবেশ

বনাঞ্চলের জমিতে চিংড়ির চাষ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
বনাঞ্চলের জমিতে চিংড়ির চাষ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমাদের দক্ষিণাঞ্চল নোনাজলে আবদ্ধ। জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর যে প্রকৃতিগতভাবে প্রভাব ফেলছে, তার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু চিংড়ির চাষ বা ঘের এ অঞ্চলকে কৃত্রিমভাবে লবণাক্ত করে তুলছে। ঘের হলো উঁচু মাটির দেয়ালে পরিবেষ্টিত নোনাজ, যাতে চিংড়ির চাষ হয়। ঘের অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল। কেউ চিংড়ি চাষ করেন। কেউ সে চিংড়ি বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ বা চিংড়ি মাছের পোনা বিক্রি করেন। কারও ব্যবসা বরফের। অনেকে আবার চিংড়ি মাছ পরিবহন ব্যবসায়ে জড়িত। বলা বাহুল্য, এখানকার অধিকাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল। যাঁদের ঘের নেই, তাঁরা অন্যের ঘেরে শ্রম দেন, আইল বাঁধেন, শেওলা বাছেন। এ অঞ্চলে নুন থেকে কাঠ—সবই কিনতে হয়। চারদিকে সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। কেবল দু-একটি নারকেলগাছ মাথা তুলে আছে। অন্য সব বৃক্ষ সারা বছর থাকে রুগ্‌ণ। এ অঞ্চলে গরু-ছাগল নেই। হাঁস-মুরগির সংখ্যাও খুব কম। কিন্তু কয়েক যুগ আগেও, এসব অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা এ রকম ছিল না। একসময় এখানকার মাঠ ছিল সবুজ শস্যে ভরা। প্রচুর ধান চাষ হতো, সবজির চাষ হতো।

সবুজের উদাহরণ হতে পারে আজকের সাতক্ষীরা জেলা। এ জেলার আশাশুনি উপজেলার নাকতাড়া গ্রাম রাজধানী থেকে প্রায় চার শ কিলোমিটারের দূরত্ব। সড়কপথে এখান থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ১০ কিমি। নদীপথে আরও কম। এ অঞ্চলের সবচেয়ে কাছের নদীটির নাম খোলপেটুয়া। খালি চোখে দেখার দূরত্ব। এই গ্রামের গ্রামপুলিশ শিবু পদ গাইন। বাবা ভদ্র গাইন ছিলেন এলাকার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। আলাপ প্রসঙ্গে গ্রামের বাসিন্দা শিবু বললেন, ‘আগে এ এলাকায় ধান হতো। আমরা গরু পালতাম। শাক-টাক লাগাতাম। কত শা‌ন্তি ছেলো আমাগি। এখন জমিত্ আর কিচ্চু হয় না। হয় খালি কডা চিংড়ি। গরু-টরু নেই, গাছ-পালাও নেই। খাবার পানি তুলতি ৫০০ ফুট নিচে যাতি হয়। ভবিষ্যতে যে কী হবে আমাগি?’

তিনি আরও যোগ করলেন, ‘আমাগের বাপ-দাদার পেশা ছেলো কৃষিকাজ। এলাকার মানুষ তা ছাড়তি চায়নি। তারা বাধ্য হয়ে ঘের করে।’

প্রায় দুই যুগ আগে এই কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি চিংড়ির চাষ শুরু করেন। এলাকার লোকজন তখন প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রাণও দিয়েছিলেন। কিন্তু অস্ত্র ও অর্থের কাছে সে প্রতিবাদ পরাস্ত হয়। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে চাষযোগ্য উপকূলীয় জমির ৫ শতাংশে চিংড়িঘের করা হয়েছে, প্রতিবছর বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা এলেও ক্ষতির পরিমাণ বিশাল। আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের গবেষণায় জানা যায়, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে কৃষিজমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাব মতে, খুলনা বিভাগে স্থানীয় চিংড়ি ব্যবসায়ীরা প্রায় তিন হাজার স্লুইসগেট তৈরি করেছে। বাঁধে অবৈধভাবে ছিদ্র করা হয়েছে অন্তত ১০ হাজার। এসব অননুমোদিত স্লুইসগেট ও ছিদ্র প্রতিনিয়ত দুর্বল করছে বেড়িবাঁধ। পানি ধারণক্ষমতা কমছে। সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন।

কথা ছিল, চিংড়িঘেরের মাধ্যমে এই অঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ‘সাদা সোনা’য় শক্তিশালী হবে অর্থনীতি। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। দারিদ্র্য মানচিত্রে চিংড়ির এক বিরূপ প্রভাব পড়েছে আমাদের অর্থনীতিতে। ঘের ব্যবসার কাছে ছোট ছোট জমির মালিকেরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। যাঁদের জমি নদী থেকে একটু দূরে, তাঁরাও জিম্মি হয়ে পড়েছেন। নোনাজল পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আবার আশপাশে অন্যরা ঘের করায়, চারদিকে নোনাজলের প্রভাবে, ওই জমিতে অন্য কোনো ফসলও ফলানো সম্ভব হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা প্রভাবশালীদের কাছে কম দামে জমি ইজারা দেন। বিঘাপ্রতি মাত্র ৮-১০ হাজার টাকায়, অথবা আরও কমে।

ফলে দারিদ্র্যরেখা এ অঞ্চলে ক্রমাগত প্রশস্ত হচ্ছে। আঞ্চলিক বৈষম্যও বাড়ছে। বিবিএসের ২০১৬ সালের আগস্টে প্রকাশিত জরিপ অনুসারে, দেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু সাতক্ষীরা জেলার ৫৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র, অর্থাৎ চিংড়ি চাষ এ অঞ্চলের গণমানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপর তুলে আনতে পারেনি। আগে যেসব মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, এখন তাঁরা হয়তো বেকার, নয়তো শহরমুখী।

আজকের বিশ্বে পরিবেশ বিনাশী নানা কর্মকাণ্ড চলছে। এ জন্য আমরা উন্নত দেশগুলোকে দায়ী করি। সত্যিকার অর্থে, তারাই বেশির ভাগ দায়ী। কিন্তু স্থানীয়ভাবে আমাদেরও কিছু দায় আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশ্বের অন্যতম বিপন্ন এলাকায় পরিণত হতে চলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা বাড়ছে। তাই সিডর, আইলা আমাদের উন্নয়নচিত্রকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। আমরা যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কাটছি। ফসলি জমিতে নোনাজল তুলছি। প্রকৃতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছি। চিংড়ি চাষ অনেকের গণকর্মসংস্থান কেড়ে নিয়েছে।

আমরা বাগদা চিংড়ি চাষের বিপক্ষে নই। কিন্তু আমাদের চিংড়ি চাষের ক্ষতিকারক দিকগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। পরিবেশকে বিষাক্ত করে, বিপর্যস্ত করে, আমরা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারি না। চিংড়ি চাষকে যদি এখনই কঠোর নীতিমালার আওতায় আনা না হয়, তাহলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ, প্রকৃতি ও অর্থনীতি আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

উমর ফারুক: শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
[email protected]