আইসিসিতে মত দিতে দ্বিধা

১১ জুনের মধ্যে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের দ্বারা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে তদন্ত ও বিচারে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার সংক্রান্ত বিষয়ে উত্তর দিতে হবে। কিন্তু পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে ইঙ্গিত মিলছে যে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের আশায় বাংলাদেশ আইসিসির অনুরোধে সাড়া না–ও দিতে পারে। উপরন্তু মিয়ানমার নাকি বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে যে এই পথে গেলে ‘দ্বিপক্ষীয়’ ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন শেষ করার চলমান প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশকে এখন তার জাতীয় স্বার্থে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশকে নিশ্চয় তার নিকটতম প্রতিবেশীর স্পর্শকাতরতার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু আমরা শুরু থেকেই এ কথা বলে আসছি যে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত বা ত্বরান্বিত যা–ই হোক, প্রত্যাবাসন এবং অপরাধের তদন্তের বিচারের প্রশ্নকে আলাদা করতে হবে। কোনো রাষ্ট্রই কোনো একটি জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের বৈধতার প্রশ্ন তুলে নির্বিচারে এভাবে বিতাড়ন এবং তা করতে গিয়ে বর্বরতা চালাতে পারে না। সুতরাং এই অপরাধের সঙ্গে যারাই যুক্ত, তাদের বিষয়ে আইসিসিসহ যারাই স্বাধীন তদন্ত করার উদ্যোগ নেবে, বাংলাদেশকে সেই প্রক্রিয়ার প্রতি নীতিগত সমর্থন দিতে হবে। যদিও আইসিসির এখতিয়ার প্রশ্নে রোম সংবিধির অন্যতম অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে এটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে যে মিয়ানমার এর পক্ষ না হলেও বাংলাদেশ এর পক্ষভুক্ত এবং সেই হিসেবেই আইসিসি বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছে যে এতে বাংলাদেশের মত দেওয়া না–দেওয়ার ওপরই যে সবকিছু নির্ভর করছে, তা নয়। আইসিসির প্রসিকিউটররা বাংলাদেশের সম্মতির আশায় থাকেনি, এখন বিচারের এখতিয়ার–সংক্রান্ত যে প্রশ্ন উঠেছে, তার একটা সুরাহা আইসিসির প্রাক্–বিচারিক আদালত নিশ্চয় দেবেন।

আমরা বিশ্বাস করি, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো মিত্ররা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সংকট সমাধানে উৎসাহ দিতে পারে কিন্তু দেশগুলো বলতে পারে না যে তারা অপরাধের কোনো স্বাধীন তদন্ত উদ্যোগকে সমর্থন করে না। বাংলাদেশ ও তার মিত্রদের এটাও বিবেচনায় নিতে হবে, নিরাপত্তা পরিষদের অনীহা থাকলে আইসিসির প্রক্রিয়া সফল হওয়ার সহজ রাস্তা নেই। আবার কোনো কারণে আইসিসির এখতিয়ার বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের প্রশ্ন গুরুত্ব হারাবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার দায় এড়াতে পারবে না।

মিয়ানমার এখনো পর্যন্ত তার পদ্ধতিগত রোহিঙ্গা-বিদ্বেষ নীতি থেকে একচুল সরেছে বলে প্রমাণ নেই। এখন আইসিসিতে সম্মতি দিলে মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রদর্শন করেছে, তার প্রকৃত ভিত্তি খুবই নড়বড়ে। বাংলাদেশের দেওয়া আট হাজার রোহিঙ্গার প্রথম তালিকা থেকে এক হাজার জনকে ছাড়পত্র দিতেই তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে এবং এ ক্ষেত্রে ‘স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের’ শর্ত পূরণ হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আবার আইসিসির প্রক্রিয়া চলমান থাকতে মিয়ানমার যেনতেনভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করার কৌশল নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রশ্নে আইসিসিকে তার নীতিগত ও আইনগত অবস্থান অবহিত করার বিষয়টি তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সবকিছু নিয়ে দর–কষাকষি কিংবা কূটকৌশলের কথা চিন্তা করলে চলে না।

বাংলাদেশ এই প্রশ্নে নীরব থাকলে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রে খেসারত দিতে হতে পারে। মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত শরণার্থীদের ফেরত না নিলে দেশটির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অবরোধ আরোপের দাবি তোলার মুখ আর বাংলাদেশের থাকবে না। সরকারের নীতিনির্ধারক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।