'আব্বু, তুমি কানতেছ যে...?'

সাম্প্রতিক মাদকবিরোধী অভিযান ও কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা যতই সোচ্চার হোন না কেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে এর প্রতি জনসাধারণের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। দেশে যখন খুন-ধর্ষণ, মাদক পাচার ও সেবনের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পায়, তখন অতিষ্ঠ নাগরিকেরা আলাপ-আলোচনায় বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশ করে থাকেন যে এই অপরাধীদের গুলি করে হত্যা করা উচিত। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন সে রকমই কোনো উদ্যোগ নেয়, তখন তা স্বাভাবিক কারণেই জনসমর্থন পায়। অর্থাৎ ক্রমবর্ধমান অরাজক অবস্থার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় দেখতে চান তাঁরা। কিন্তু অপরাধ ও শাস্তির বিষয়টিকে যে এতটা সরলীকরণ করা যায় না, সেটা বুঝতে সময় লেগে যায়। তখনই হয়তো প্রশ্ন ওঠে, কুইনিন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনিন সারাবে কে?|

সাম্প্রতিক অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার পর এখন সেই ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার’ কথাটিই উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র। একরাম নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের কথোপকথন এবং ওই সময়ের পরিস্থিতির একটি অডিও টেপ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর মাদকবিরোধী অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই ঘটনার পর বলেছেন, ‘এ ধরনের অভিযানে দু–একটা ভুল হতেই পারে।’ কাদেরের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। তাঁর না বোঝার কথা নয়, এ রকম দু-একটা ভুলের অভিঘাত জনমানসে অনেক বড় ভুলকেও ছাপিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে জেগে থাকে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ফোনালাপে একরামুলের শিশুকন্যার আকুল কণ্ঠস্বর, ‘আব্বু, তুমি কানতেছ যে...?’—আরও বহুদিন প্রতিধ্বনিত হবে মানুষের মনে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ ঘটনার তদন্ত হবে। জানি না কবে কখন সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে, তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, যত দিন না সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে, তত দিন মানুষের আতঙ্ক ও আস্থাহীনতা কাটবে না।

মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। আটকও করা হয়েছে কয়েক শ মানুষকে। এদের মাদক-সম্পৃক্ততা নিয়ে অনেকটাই নিঃসংশয় ছিল সাধারণ মানুষ। বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে মানবাধিকারকর্মীদের ক্ষীণ প্রতিবাদ চাপা পড়ে গেছে সাধারণ মানুষের একধরনের আশা ও স্বস্তির মধ্যে। মানুষ মাদকের ভয়াবহতা থেকে সমাজের মুক্তি চেয়েছে। কিন্তু আইনকে পাশ কাটিয়ে শাস্তির প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত কী রকম বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা তারা লাভ করল একরামের মৃত্যুর ঘটনা থেকে।

নিহত ব্যক্তিদের শুধু ‘সংখ্যা’ হিসেবে ধরে নিয়ে, ভিড়ের মধ্যে একটি বা দুটি (এমনকি নিরপরাধ হলেও) সংখ্যা বেড়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়াটির কোনো তারতম্য ঘটবে না বলে যদি মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু ‘অসাধু’ সদস্য, তাহলে ব্যাপারটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সাম্প্রতিক ঘটনা তারই একটি উদাহরণ। ‘অসাধু’ সদস্য কথাটি এখানে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারছি, কারণ মাদক ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগীদের নামের যে তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেছে, তাতেও এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের নাম।

বাংলাদেশের দক্ষিণের সীমান্ত টেকনাফ অঞ্চলটি মাদকের অবাধ আমদানি ও ব্যবসার জন্য বহুল আলোচিত। অন্তত এক দশক ধরে এখানকার সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নামের মাদকদ্রব্যটি এ দেশে আসছে। অনেকে মনে করেন, কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে এ দেশে ঠেলে দিয়ে মিয়ানমার আমাদের যত বড় বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে, ইয়াবা পাঠিয়ে তার চেয়ে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাধির সংক্রমণ ঘটিয়েছে আমাদের সমাজে।

টেকনাফের কিছু অসৎ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি কীভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে ইয়াবা আমদানি ও এর বাজারজাত প্রক্রিয়ায়, তার শিউরে ওঠা বিবরণ আমরা এখন নিয়মিত পাচ্ছি পত্রপত্রিকায়। এসব ব্যক্তির সারি সারি প্রাসাদোপম বাড়ির ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। এক দিনে এসব ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এসব তথ্য ছিল না, তা-ও নয়। কিন্তু তারা মাঝেমধ্যে কিছু মাদকদ্রব্যের চালান আটকের পর পত্রপত্রিকায় তা ফলাও করে প্রকাশ করেই নিজেদের ‘দায়িত্ব’ সম্পন্ন করেছে। মূল হোতাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি বা করতে চায়নি।

মাদক পাচার ও বাণিজ্যের মূল হোতা হিসেবে বারবার এসেছে টেকনাফের সরকারদলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদির নাম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি গোপন প্রতিবেদনে এমনকি এ মন্তব্যও করা হয়েছে যে, ‘সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দেশের ইয়াবা-জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না। দেশের ইয়াবা বাণিজ্য বন্ধের জন্য তাঁর ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’ কিন্তু ঢাকঢোল বাজিয়ে এত বড় অভিযান পরিচালনার সময়ও আটক করা হয়নি তাঁকে। একরামুলের মৃত্যুর পর কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তীব্র বাদানুবাদ হয়েছে বলে পত্রপত্রিকার সংবাদে জেনেছি। সাবেক সাংসদ ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী খোদ আবদুর রহমান বদির উপস্থিতিতে তাঁকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আপনি ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এ দেশে ইয়াবা পাচারের কাজ শুরু করেছেন। আপনি গত ১০ বছরে গোটা দেশটাকে ইয়াবায় ছেয়ে দিয়েছেন।’ (কালের কণ্ঠ, ১৯ মে)।

গত ৩০ মে ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে গেছেন আবদুর রহমান বদি। ‘নিরাপদ’ পরিবেশ সৃষ্টি না হলে তিনি দেশে ফিরবেন কি না সেই সন্দেহ এখন অনেকের মনে। রাঘববোয়ালরা এভাবে পার পেলে চুনোপুঁটি মেরে যে উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে না, তা তো বলাই বাহুল্য। উপরন্তু এই অভিযানে ‘সামান্য ভুলে’ কিছু নিরপরাধ মানুষের জীবন পড়ছে ঝুঁকির মুখে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লঘু পাপে গুরুদণ্ডও হয়ে যাচ্ছে কারও কারও।

এই অভিযানের সুযোগ যে কারা কীভাবে নিচ্ছে, তার একটি বড় নমুনা দেখা গেল কয়েক দিন আগে বোয়ালখালীতে ষাটোর্ধ্ব বয়সী একজন আইনজীবীকে ফাঁসানোর ঘটনায়। জমিজমা–সংক্রান্ত বিরোধের সূত্রে পুলিশ লন্ডনপ্রবাসী এক ব্যক্তির পক্ষ হয়ে গ্রেপ্তার করেছে সমরকৃষ্ণ চৌধুরীকে (৬৫)। শুধু গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর ঘরে ইয়াবা ও অস্ত্র পাওয়া গেছে বলে প্রচার করেছে। সমরকৃষ্ণের ছবি তোলা হয়েছে হাতে ভারী অস্ত্র দিয়ে। অস্ত্র হাতে এই প্রবীণ ব্যক্তির ছবি দেখে একজন নাবালকও বলে দিতে পারবে, এই অস্ত্র বহনের সামর্থ্য নিতান্ত ছাপোষা মানুষটির নেই। সমরকৃষ্ণের মেয়ে অলকানন্দা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর বাবাকে শহরের জহুর মার্কেট এলাকা থেকে আটক করে বোয়ালখালীতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িতে নিয়ে হাতে একটি অস্ত্র ও ইয়াবা দিয়ে ছবি তোলানো হয়। অলকানন্দার সৌভাগ্য, একরামুলের মেয়ের মতো টেলিফোনে পিতার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনতে হয়নি, তাঁর পিতার মৃত্যুও হয়নি। কিন্তু এসব ঘটনা সমাজকে আতঙ্কিত করে তুলছে, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা বাড়ছে।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দু-একটা ভুল হতেই পারে।’ কিন্তু শোধরানোর ব্যবস্থা দ্রুত না নিলে ভুলের সংখ্যা যে বাড়তেই থাকবে, তার আলামত এখন স্পষ্ট।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক