মধ্যবিত্ত তো আর (ঋণ) খেলাপি নয়!

অর্থমন্ত্রীদের বাজেট বক্তৃতা হচ্ছে সেই যাজকের মতো, যিনি তাঁর প্রার্থনাসভায় আসা পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে একটা সুসংবাদ আছে, তার সঙ্গে অবশ্য একটা দুঃসংবাদও আছে। সুসংবাদ হলো শিগগিরই আমরা আমাদের নতুন গির্জা ভবনে যেতে পারব।’ স্বাভাবিকভাবেই সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাঁরা খুশি হলেন যে এ রকম ছোট, স্যাঁতসেঁতে, দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে একটা ভালো জায়গায় গিয়ে খোলামেলা, আলো ঝলমলে ভবনে প্রার্থনাসভায় মিলিত হওয়া যাবে। তখনই যাজক বললেন যে দুঃসংবাদ হচ্ছে, ‘ভবনটি বানানোর টাকা এখনো আপনাদের পকেটে। আপনারা যত তাড়াতাড়ি তা দিয়ে দেবেন, আমরা তত তাড়াতাড়ি সেই নতুন ভবনের কাজ শুরু করতে পারব।’
অর্থমন্ত্রীর কাব্যিক শিরোনাম ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রা’র বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ নিশ্চয়ই সেই সুখানুভূতি জাগানোর মতো সুসংবাদ। কিন্তু কর প্রস্তাবের খুঁটিনাটিগুলো পরিষ্কার হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এখন রব উঠেছে, এটি হচ্ছে মধ্যবিত্তের জন্য দুঃসংবাদ। মধ্যবিত্তের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই শ্রেণিটি আকাঙ্ক্ষাতাড়িত। ভালো জীবনের আকাঙ্ক্ষা। ভালো জীবন মানে ছেলেমেয়ের ভালো লেখাপড়া, ভালো চাকরি, ভালো কাপড়, ভালো খাওয়া, ভালো চলাফেরা। বাংলাদেশে জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ মধ্যবিত্ত, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান—বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেনের ২০১৫ সালের হিসাবমতে দেশের সাড়ে ২২ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত। তার মানে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশই চাকরিজীবী, তাঁরা ফ্ল্যাট কিংবা জমির মালিক, ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, টাকাপয়সা রাখেন ব্যাংক হিসাবে। ১৯৯২ সালে মধ্যবিত্তের পরিমাণ ছিল ৯ শতাংশ। তাঁর ধারণা, ২০৩০ সালে এটি ৩৩ শতাংশে পৌঁছাবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের জন্য জনগোষ্ঠীর এই অংশটিকে অর্থমন্ত্রী (যিনিই হোন না কেন) বেছে নেবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।
গায়ের দুর্গন্ধ দূর করার তাড়া কিংবা ভালো কাপড়ের দিকে নজর তো মধ্যবিত্ত পরিবারেই বেশি থাকার কথা। গাদাগাদি ভিড়ের বাসের চেয়ে যদি উবারের কিংবা পাঠাও-এর গাড়ি পাওয়া যায়, তাহলে একটু ‍সুবিধা হয় কার? সামর্থ্য আরেকটু বেশি হলে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির কথাও তো সে রকম পরিবারই ভাবে। ছোট একটা গোছানো ফ্ল্যাটে তো ধনীদের নজরও থাকে না, গরিবেরও নয়। ওটা মধ্যবিত্তের বেশি প্রয়োজন। একটু নিরাপত্তা, বিশেষ করে ভবিষ্যতের জন্য। সারা জীবনের সঞ্চয় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে অনেকেই তো ‘চুনে মুখ পুড়িয়েছেন’। সুতরাং, তাঁদের কাছে সঞ্চয়পত্রের চেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ আর কী হতে পারে? মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের পর অর্থমন্ত্রী মধ্যবিত্তের পকেটে নজর দেবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

বিত্তবানদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় অনেকেই ক্ষুব্ধ। কিন্তু তাঁদের বোধ হয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, এসব বিত্তবানের বিত্তের একটা বড় অংশই তো দেশে নেই। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির হিসাবমতে, শুধু ২০১৪ সালে এক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ধারণা করা অমূলক হবে না, গত চার বছরে অঙ্কটি লাখো কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যে সম্পদ দেশে নেই তার ওপর অর্থমন্ত্রী কর বসাবেন কী করে? আর, হ্যাঁ, ব্যাংক পরিচালকদের কথা বলবেন? ওঁনাদের একটা বড় অংশই তো এক ব্যাংকের খেলাপি হয়ে অন্য ব্যাংকের পরিচালক। খেলাপি মানে তিনি ঋণ পরিশোধে অক্ষম। ধার পরিশোধে অক্ষম লোকজনের ওপর কর আরোপ করলে তো তাঁরা আবার করখেলাপি হয়ে পড়বেন। মধ্যবিত্ত অন্তত করখেলাপি হতে পারে না। সুতরাং, তাদের ছাড় দেওয়া তো প্রজ্ঞার পরিচায়ক!
শেষ করব আরেকটি কৌতুক দিয়ে। আমেরিকায় এক ব্যাংকে পরপর কয়েকবার ডাকাতি হলো। ব্যাংক ডাকাতি যেহেতু গুরুতর অপরাধ, সেহেতু ডাক পড়ল দেশটির চৌকস তদন্তকারী এফবিআইর এজেন্টদের। এফবিআইর এজেন্টরা ব্যাংকের কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করা হচ্ছে, ডাকাতদের কাউকে চিনতে পেরেছেন কি না? তারা দেখতে কেমন ছিল, কজন ছিল ইত্যাদি। নজরে পড়ার মতো কিছু ছিল কি না, জানতে চাইলে ব্যাংকাররা প্রায় সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘প্রতিবারই ওরা আগের চেয়ে ভালো পোশাক পরে এসেছে।’ যাঁরা টেলিভিশনে বাজেট বক্তৃতা দেখেন তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন, অর্থমন্ত্রীরা আগেরবারের চেয়ে ভালো পোশাক পরে আসেন কি না। পোশাকে অন্তত উন্নতির একটা ছাপ পাওয়া যায় কিনা?

কামাল আহমেদ, সাংবাদিক