একরামুলের অনেকগুলো অপরাধ

একরামুল সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন মেরে ফেলা হবে তাঁকে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন সন্তানদের কাছে তা লুকাতে। কিন্তু আশপাশে মৃত্যুদূতদের নিয়ে শেষযাত্রায় ভীতি এতই তীব্র ছিল যে তিনি সেটা পারেননি ভালোভাবে। ফোনে তাঁর কন্যা আকুল হয়ে প্রশ্ন করেছে: ‘আব্বু, তুমি কানতেছ যে?’

কেন কাঁদছে তার বাবা, তা কয়েক মুহূর্ত পরই বুলেট আর গোঙানির শব্দ শুনে বুঝেছে তারা। একরামুলের কিশোরী কন্যাদের আর্তি তাই প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে বাংলাদেশের নরম মাটিতে। শত অন্যায়েও যাঁরা কোনো দিন কিছু বলেননি আগে, তাঁরাও প্রতিবাদ করেছেন এই নির্দয় হত্যাকাণ্ডের।

একরামুল তাই বলে একা নন এ দেশে। একরামুলের মতো অনেক মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, তাঁদেরই দেশের বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে এক অদ্ভুত ‘বন্দুকযুদ্ধে’। যুদ্ধ হলে গোলাগুলি বিনিময় হয়, কিন্তু এই অদ্ভুত যুদ্ধে গুলি খায় কেবল মানুষ, বাহিনীর কেউ না। একরামুলের মৃত্যু-মুহূর্তগুলোর অডিও রেকর্ড থেকে জানা গেল, এই যুদ্ধে গুলিও করে কেবল একটি পক্ষ, অন্য পক্ষ করে মৃত্যুযন্ত্রণার গোঙানি।

এই যুদ্ধ নাকি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এর আগে বিভিন্ন ধরনের নানা অভিযান ও যুদ্ধ হয়েছে। এসব যুদ্ধে অতি বিরল দু-একটি ঘটনা বাদে সব ক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছে শুধু সাধারণ মানুষ।

একরামুল ছিলেন সরকারেরই লোক, যুবলীগের স্থানীয় নেতা। তাঁর মারা যাওয়ার কথা ছিল না তাই! তবু তিনি মারা গেলেন কেন? কী ছিল তাঁর অপরাধ? কী ছিল একরামুলের মতো খুন হওয়া বা চিরতরে নিখোঁজ হওয়া হাজারো মানুষের অপরাধ?

  ২.

একরামুলের প্রথম অপরাধ তাঁর নাম একরামুল। একই নামে একজন পরিচিত মাদক ব্যবসায়ী আছেন টেকনাফেই। একরামুলের জানা উচিত ছিল, এ দেশে শুধু নামের মিল থাকলে কখনো কখনো মানুষ বিনা অপরাধে জেল খাটে, শাস্তি পায়, এমনকি বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়। এসব মহা অন্যায়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না দেশে, বরং এসব অন্যায় ধরা পড়লে স্রেফ ‘দু-একটা ভুল’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করেন শক্তিধরেরা। একরামুল একদমই বুঝতে পারেননি তা।

একরামুলের দ্বিতীয় অপরাধ তাঁর নামও এসেছিল কোনো এক সময়ে একটি বেসরকারি টিভির একটি ‘অনুসন্ধানী’ রিপোর্টে। এটা সত্যি, তাঁর চেয়েও শত গুণে বেশিবার অভিযুক্ত ছিলেন তাঁরই এলাকার সাংসদ বদি, পাঁচ-পাঁচটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবেও নাম এসেছিল তাঁর। মাদক অভিযানের শুরুতে সারা দেশে ইয়াবা-সম্রাট হিসেবে পরিচিত এই সাংসদ এবং এক শক্তিধর মন্ত্রীর একই ধরনের মালা গলায় জড়িয়ে সহাস্য ছবি দেখে একরামুল কী বুঝেছিলেন কে জানে! কিন্তু এসব দেখে তিনি কেন ধরে নেবেন সামান্য কোনো অশ্রুতপ্রায় অভিযোগে তাঁকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হতে পারে না কোথাও?

সরকারি দল করলে এ দেশে হাজারো অভিযোগ, হাজারো আলামতের পরও কিছু বড় অপরাধীর বিচার হয় না ‘প্রমাণ’-এর অভাবে। একরামুলের বোঝা উচিত ছিল, বড়মাপের দূরের কথা, ছোটখাটো অপরাধী হিসেবেও নাম করতে পারেননি তিনি, সেটি করার সম্ভাবনাও ছিল না। তাঁর বোঝা উচিত ছিল, চুনোপুঁটি মাপের মানুষ তিনি, সরকারি দলের এমন দু-একজন চুনোপুঁটি মরলে মাদক অভিযানের নিরপেক্ষতা বরং প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে।

একরামুলের আরেকটি অপরাধ, তিনি বাংলাদেশের মানুষ এই সময়ে। অথচ এই বাংলাদেশকে চিনতে পারেননি তিনি। একরামুল বুঝতে পারেননি কোনো এক আদেশে, কারও এক তালিকা অনুযায়ী নির্দ্বিধায় তাঁকে মেরে ফেলা যাবে। আদালতের বিচার রাস্তাঘাটে হয় এ দেশে, সেই বিচারে কিছু বিরোধী দলের সঙ্গে ভুল করে হলেও একজন সরকারি দলের ছোটখাটো মানুষ মরতে পারে—সেটা বুঝতে পারেননি তিনি।

একরামুলের শেষ অপরাধ, তিনি ভুল করে হলেও মোবাইল ফোন অন রেখেছিলেন মৃত্যুর মুহূর্তগুলোতে। গুলি করেছে একতরফাভাবে তাঁর হত্যাকারীরা, তাঁকে হত্যা করার পর পকেটে ইয়াবা আর পাশে পিস্তল রাখার শলা করেছে তারাই। এসব কণ্ঠ কী বিব্রতকর অবস্থাই না তৈরি করেছে মাদকবিরোধী অভিযানে। মাদকযুদ্ধের নায়কেরা হয়েছেন ভিলেন, মাদকযুদ্ধ নিয়ে যাঁরা উচ্ছ্বসিত, তাঁরা হয়েছেন লজ্জিত। পালিয়ে থেকে এখন তাঁর এই অপরাধের দায় বহন করতে হচ্ছে তাঁর ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত পরিবারকে। যে দেশে বিচারের দাবি করার সাহস হয় না বহু স্বজনহারা পরিবারের, যে দেশে চেষ্টা করেও বিচার পায় না খুনে-গুমে হৃদয় তছনছ হওয়া পরিবার, সেখানে কী দরকার ছিল তাঁর এসব করার?

 ৩.

এক অর্থে একরামুলের অপরাধ বিএনপি, জামায়াত বা দলহীন যে মানুষেরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের চেয়েও বেশি। তাঁরাও খুন হয়েছেন একই নির্মমতায়, একই রকম ভয়াবহতায়। বিএনপির একজন ছাত্রনেতা নুরুজ্জামান জনির গায়ে ছিল ১৪টি বুলেট। তিনি নাকি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের দোহাই দিয়ে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন এক অফিসার ইন–চার্জের কাছে। তাঁর সন্তান কোনো দিন না দেখতে পাওয়া বাবার ছবি পেছনে রেখে এখন বিচার চায় এই হত্যাকাণ্ডের। জনির মতো করুণ, তার চেয়েও করুণ বহু মৃত্যু আর গুমের অভিযোগ শুনি আমরা স্বজনহারা পরিবারের আর্তনাদে ভরা অনুষ্ঠানে।

কিন্তু জনিরা তবু ভালো একরামুলের চেয়ে। তাঁরা কোনো অডিও টেপ রেখে যাননি পেছনে। কেউ শোনেননি তাঁদের সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী, শিশুসন্তান বা বৃদ্ধা মায়ের আর্তনাদ। কেউ শোনেননি তাঁদের গোঙানো, মৃত্যুযন্ত্রণা, বেঁচে থাকার আর্তি। কেউ শোনেননি তাঁদের হত্যার সময় একতরফা গুলি। তাঁদের স্বজনেরা এখন কেঁদেকেটে বহু কথা বলতে পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাঁদের গুম দিবস বা খুন দিবস মাত্র এক দিন। সরকারের শতকণ্ঠ সারা বছরের। সারা বছর সরকার আর তার গুণমুগ্ধ ভক্তবৃন্দ বলতে পারেন অন্য কথা। বলতে পারেন, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ভয়াবহ সব সন্ত্রাসী, জঙ্গি আর মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যা করতে বাধ্য হয়েছে তারা। কিংবা বলতে পারেন, কীভাবে ওত পেতে থাকা সহযোগীদের গুলিতে বা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন তাঁরা। বলতে পারেন জনিদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে, যড়যন্ত্রমূলক, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রবিনাশী।

জনিরা খুব সামান্যই বিব্রত করতে পারেন সরকারকে। তাঁদের মৃত্যুতে ফেসবুক দলমত-নির্বিশেষ হয়ে যায় না, প্রগতিশীলেরা বিবৃতি দিয়ে বসেন না, বিদেশি দূতাবাস তৎপর হয়ে ওঠে না। আইন-আদালত কই, সংবিধান কই, মৌলিক অধিকার কই, তা নিয়ে শোরগোল হয় না। কিছু শোরগোল যাঁরা করার চেষ্টা করেন দেশ ও উন্নয়নের শত্রু বলে তাঁদের বরং কষে গালি দেওয়া যায় নিয়ন্ত্রিত ও নিমজ্জিত গণমাধ্যমে।

কিন্তু একরামুলের ক্ষেত্রে? তাঁর ক্ষেত্রে এসব করা অসম্ভব না হলেও কঠিন। তাঁকে বিএনপি-জামায়াত বলা যাবে না, তাঁর অডিও টেপ ভুয়া বলে কারও বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়াও কঠিন, এই টেপের কারণে তাঁকে আসলে অন্য কেউ মেরে ফেলেছে, সেটা বলাও মুশকিল। একরামুল আর পরিবার মিলে কেঁদেকেটে যত না অন্যায় করেছে, তার চেয়ে বেশি অন্যায় হয়েছে এসব রেকর্ড হওয়াতে, মানুষের কাছে তা চলে যাওয়াতে।

তবে ভরসার কথা হচ্ছে, সরকারের হাত অনেক লম্বা। গলা আরও লম্বা। উন্নয়ন উদ্‌যাপন, উৎসব ও উল্লাসে একরামুলের অডিও কান্না ঢেকে দিতে বেশি সময় লাগবে না তাদের। তত দিন পর্যন্ত একরামুলের পরিবারকে ভয়ে থাকতে হবে, থাকতে হতে পারে আরও অনেক দিন পালিয়েও।

বন্দুকযুদ্ধের মহিমাকে ক্ষুণ্ন করার জন্য এটুকু শাস্তি প্রাপ্য নয় তাদের?

এমনই তো বাংলাদেশ এখন আমাদের!

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক­­