১৩ বছর পরে ফিদেলের দেশে

হাভানা শহরে এখনো বৃহত্তম মুখ চে গুয়েভারার
হাভানা শহরে এখনো বৃহত্তম মুখ চে গুয়েভারার

২০০৫ সালের পর আবার কিউবায় এসেছি। এর মধ্যে এ দেশে বেশ কয়েকটি বড় পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। ফিদেল গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন, ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন। সম্প্রতি রাউল কাস্ত্রো ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। নতুন মুখ ক্যানাল গ্রহণ করেছেন কিউবা সরকারপ্রধানের দায়িত্বভার। ২০০৮-এর পর কয়েক দফা অর্থনৈতিক সংস্কার হয়েছে।

গতবার হাভানায় ফিদেলের কোনো বড় ছবি, বিলবোর্ড, কিংবা তাঁর নামে নামকরণ দেখিনি। ভেবেছিলাম তাঁর মৃত্যুর পর হয়তো এসব ঘটনা ঘটবে। না, শহরে এখনো বৃহত্তম মুখ চে গুয়েভারার। তাঁর পাশে বিপ্লবী ক্যামিলো। দেশের বিভিন্ন স্থানে কিউবার বিভিন্ন কালের গুণী বা বিপ্লবী মানুষের ভাস্কর্য, একটি-দুটি ফিদেলের ছবি, কবি-দার্শনিক যোদ্ধা হোসে মার্তি সর্বত্র। একক ফিদেল নয়, সারা দেশে বিভিন্ন ভাস্কর্য আর নামকরণ থেকে বহুজনের গৌরবময় ভূমিকা মানুষের সামনে উপস্থিত থাকে।

বাংলাদেশ থেকে কিউবায় এলে বহু কিছুই একধরনের হাহাকার তৈরি করে। এখানে বেকারত্ব, ক্রসফায়ার, আটক-নিয়োগ-বাণিজ্য, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী শাসন, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেষ, যৌন নিপীড়ন ও বৈষম্যের চাপ আর আতঙ্ক নিয়ে ২৪ ঘণ্টা কাটাতে হয় না। এখানে বস্তি নেই, অনাহারী গৃহহীন নিরক্ষর মানুষ নেই, শিশুশ্রম নেই। এখানে বস্তি-কারখানা পোড়া, বাস-লঞ্চ-ভবন কবরের মানুষের আর্তি নেই। এখানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা আছে, ঘর আছে, খাওয়া আছে আর আছে আনন্দের অবসর। আছে শিশুর শৈশব, বৃদ্ধের অবসর, মানুষের সম্মান। তবে অভাবও কম নেই। কিউবায় ব্যক্তিগত গাড়ি, বহুতল ভবন, বিলাসসামগ্রী, ফ্যান, এসি, শপিং মল, টিস্যু, বৈচিত্র্যময় খাদ্যসামগ্রী, টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদির ‘অভাব’ খুব সহজেই চোখে পড়ে। কোথায় প্রাচুর্য, কোথায় অভাব, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকৃতির বৈচিত্র্য প্রাচুর্য থাকতে পারছে। কারণ, উন্নয়নের নামে হাজার লাখ কোটি ঋণের টাকা খরচ করে প্রকৃতি বিনাশ করেনি কিউবা। হাভানা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার গিয়েছি। পুরো পথের দুই পাশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নারকেলসহ নানা ফল-ফুলের গাছ, প্রায়ই বটগাছের বিশাল ছায়া। পাখির কোনো অভাব নেই। কিছু দূর পরপর পার্ক। ঘরে ঘরে না থাকলেও এসব পার্কেই ওয়াই-ফাই বা ইন্টারনেট-ব্যবস্থা। একজন কিউবান নাগরিকের ভাষায়, ‘আওয়ার ট্রিজ আর ফর কুলিং, নট ফর কুকিং।’ এডিবি বা বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প গ্রহণ করলে এসব গাছ থাকত না, সেখানে থাকত কাঠের আশায় একাশিয়া বা ইউক্যালিপটাসগাছ। ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে আমাদের দেখতে হয় কোটি টাকার সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পে আমদানি করা ছায়াবিহীন বনসাই গাছ। আর কিউবায় দেখি কৃষ্ণচূড়ার সারি, বটগাছ, ফলের গাছ। বাংলাদেশের শহর ও মহাসড়কগুলোও আম-জাম-কাঁঠালসহ আরও অসংখ্য দেশি ফল-ফুল গাছে ভরে থাকতে পারত।

কিউবার উন্নয়নদর্শন ভিন্ন, মানুষ ও প্রকৃতিবিনাশী কতিপয়ের মুনাফাকেন্দ্রিক বীভত্স পথ তারা গ্রহণ করেনি। সে জন্য এই দেশ কখনোই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবির (এখানকার তুলনীয় সংস্থা ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) মতো সংস্থার সদস্য বা অনুগামী হয়নি।

বাংলাদেশের চেয়েও কিউবার সম্পদ অনেক সীমিত, প্রাকৃতিক বৈরিতাও প্রতিবছর। তার বাইরে আছে প্রবল দানবীয় শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ। দুটি বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা পার হয়েছে কিউবা, পার হতে গিয়ে ভালো-মন্দ দুই ধরনেরই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রথম বড় ধাক্কা আসে ১৯৯০ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের পতনের পর। কারণ, মার্কিন অবরোধের মধ্যে এ দেশগুলোর সঙ্গেই কিউবার অর্থনীতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। নব্বইয়ের দশকে এই সংকট মোকাবিলার মধ্য দিয়েই প্রতিবেশ অনুকূল কৃষি ও পরিবহনের বিস্তার ঘটে (বিস্তারিত আলোচনার জন্য আগ্রহী পাঠকেরা ২০০৬-০৭-এ লিখিত আমার বই—বিপ্লবের স্বপ্নভূমি কিউবা: বিশ্বায়িত পুঁজিবাদে ল্যাটিন আমেরিকা, ২য় সংস্করণ, সংহতি প্রকাশন, দেখতে পারেন)। ২০০২-এর পর যখন ভেনেজুয়েলা হুগো চাভেজের নেতৃত্বে শক্তভাবে দাঁড়ায় এবং ২০০৬ সালে যখন বলিভিয়ায় ইভো মোরালেসের নেতৃত্বে নতুন যাত্রা শুরু করে, তখন কিউবা একটু স্বচ্ছন্দ গতিতে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে পায়। কিন্তু তার ধারাবাহিকতাও অক্ষুণ্ন থাকেনি।

২০০৭-০৮-এর বিশ্ব অর্থনীতির সংকটে কিউবাও নানামুখী সমস্যায় পতিত হয়। খাদ্য, তেলসহ আমদানি করা বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়, জোগান কমে যায়, নাগরিকদের প্রকৃত আয় কমে যায়। ২০১০ সালের পর তাই আরও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিভিন্ন পেশা গ্রহণ বা ব্যবসার সুযোগ
দেওয়া হয়েছে নাগরিকদের। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে অর্থনৈতিক সংস্কারের যে রূপরেখা অনুমোদিত হয়, তাতে সরকারি হিসাবেই ৫০ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ৪ লাখ খুদে ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেলের ওপর নির্ভরতা কিউবার দীর্ঘদিন। এখানে কিউবা বরাবরই সংকটের মধ্যে ছিল। মার্কিন অবরোধের কারণে রপ্তানি আয়ের সমস্যা, সেই কারণে তেল আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। কিউবার নিজস্ব অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদ খুবই অপ্রতুল, তবে গত এক দশকে বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রযুক্তি বিকাশের কারণে কিউবার এই পরনির্ভরতা থেকে মুক্তির নতুন সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে। কিউবায় সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির প্রাচুর্য আছে। সৌরবিদ্যুতের যাত্রা শুরু হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এর গতি অচিরেই আরও বাড়বে। ঠিকভাবে অগ্রসর হলে পরনির্ভরতা ছাড়াই বিদ্যুৎ-সংকটের টেকসই সমাধানে কিউবা সক্ষম হবে।

কিউবায় মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ৮ হাজার মার্কিন ডলার। জিডিপিতে মধ্য মধ্যম আয়ের দেশ হলেও শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, আয়ুসীমা, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছু নিয়ে মানব উন্নয়ন সূচকে কিউবা কয়েক দশক ধরেই শীর্ষ দেশগুলোর সারিতে। আর মাথাপিছু আয়ের অঙ্কটিও ফাঁপা বা বিভ্রান্তিকর নয়, এর বড় অংশ জনগণ আসলেই পায় শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থান আর প্রাণ–প্রকৃতিমুখী উন্নয়নের মধ্য দিয়ে। পুষ্টিহীন রোগা বা অস্বাভাবিক মেদবহুল মানুষ দুটোই তাই এ দেশে বিরল।

সম্পদ যতই কম হোক, বৈরী অবস্থা যতই প্রবল হোক, ন্যূনতম খাদ্য এবং শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থায় সব নাগরিকের শতভাগ অধিকার নিশ্চিত রাখার নীতিতে এখনো কোনো ছেদ পড়েনি। সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়েও দুর্বল একটি দেশ সবার জন্য বিনা পয়সায় স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা আর সবার জন্য নিশ্চিত সব ধরনের সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পেরেছে, এর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শর্তই ভাবনায় আনা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সব পেশাতেই কিউবার নাগরিকদের নগদ মাসিক আয় অনেক কম। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, মৌলিক খাদ্যের জোগান পেলেও তাদের আরও নানা চাহিদা তৈরি হচ্ছে, আরও বৈচিত্র্যময় খাদ্য, আরও সুন্দর ভবন, গাড়ি, আরও নানা বিলাসসামগ্রী, ইন্টারনেট। এই নিম্ন আয় দিয়ে এসব চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। এসব থেকে একাংশের মধ্যে অসন্তোষও তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন চাহিদা পূরণে অনেক পেশাজীবীই খণ্ডকালীন কাজ বা ব্যবসার পথ ধরছেন। বাড়তি আয়ের সুযোগ খুঁজলে পর্যটনকেন্দ্রিক কাজ বা ব্যবসাই প্রধান পথ। এ কারণে বাড়তি আয়ের আকর্ষণে চিকিৎসক, শিক্ষকেরাও যুক্ত হচ্ছেন পর্যটনসংশ্লিষ্ট নানা বাড়তি কাজে। নানাভাবে মেধার অপচয়, ছায়া অর্থনীতি, ভোগবাদিতা ইত্যাদির চাপও বাড়ছে।

বিপদ, ভুল অতিক্রমের সাহস ও শক্তি বারবার দেখাতে পেরেছে কিউবার মানুষ। এই দেশ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সংস্কার করেছে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই, ঝুঁকিও নিয়েছে বারবার। সম্পদের সীমাবদ্ধতা, সংকট আর কয়েক দশকের অন্তর্ঘাত-অবরোধেও কখনোই নতিস্বীকার করেনি কিউবা। অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে কিউবা তাই বরাবরই অনন্য বিস্ময়। তার সাফল্য, সংকট, ঝুঁকি, লড়াই সব আমাদেরও অভিজ্ঞতার অংশ।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক